রাজ্য

ইতিহাসের পাতায় ক্যানিংশহর পৌরসভা থাকলেও বর্তমানে সেটি পঞ্চায়েত?

মৃত্যুঞ্জয় সরদার, ক্যানিং:দীর্ঘ বছর আগে মাতলা বাজার নামে পরিচিতি ছিল ক্যানিং টাউন কে, আগেকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মাতলা বাজার বলতেন ছোট থেকে আমরা শুনে এসেছিলাম। ছোটবেলার ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি চৈত্র ও বৈশাখ মাসে, মাতলা নদীর মাতাল রূপ।মাতলা নদীর চরে ভ্যান রিক্সা করে মানুষ বহন করেছে, বহু টাকা ইনকাম করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।সেই মাতলা নদী আবার কখনো মেতে উঠেছে ফুলে ফেঁপে জোয়ারের জলে। আজ কিছুটা তার অবসান ঘটেছে মাতলা সেতু করার পরে। মাতলা নদীর কবলে পড়ে বহু লোকের প্রাণ গেছে নৌকাডুবি হয়ে। এই মাতলা বাজার আজ ক্যানিং সুন্দরবনের প্রবেশ পথ হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত। চটুল ম্যানগ্রোভ বনের নিকটতম রেলওয়ে এবং সড়কপথ ক্যানিং থেকে কলকাতার সঙ্গে সংযুক্ত। শিয়ালদহ দক্ষিণ লাইন থেকে ক্যানিংগামী ট্রেন চলে, যার ভাড়া ১৫ টাকা। দুটি রাস্তা বা সড়কপথ: একটি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস; দ্বিতীয়টি বাসন্তী হাইওয়ে। এই দুটি পথ  কলকাতার সঙ্গে যুক্ত। এই মহকুমার মূল স্থান ক্যানিং একটি সুপ্রাচীন জনপদ, যা গড়ে উঠেছিল বড়লাট লর্ড ক্যানিং এর নামানুসারেই। মাতলা নদীর তীরে এই জায়গাটি বর্তমানে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত। ভারতবর্ষের তৃতীয় শহর হিসেবে ক্যানিং এ রেলপথ স্থাপন হয় তৎকালীন ক্যানিং বন্দরের সুবিধার্থে ১৮৬২ সালে। উল্লেখ্য এ রাজ্যের ইতিহাসে ক্যানিংই ছিল প্রথম পুরশহর। পরে সেই তকমা যদিও মুছে যায়। মাতলা নদীর চরে গড়ে ওঠা শহর আজ ক্যানিং নামে পরিচিতি,ক্যানিংয়ের মাতলা নদী পেরিয়ে ভাঙ্গন খালি পর্যন্ত রেল সম্প্রসারণ হওয়ার কথা ছিল। মাতলা নদীর চরে রেল ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, আজ সব বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।কি কারণে রেলের কাজ যে বন্ধ হয়ে গেছে তার সদুত্তর কোনভাবে মিলছে না।ক্যানিংয়ের মানুষ যেভাবে উন্নয়নের জোয়ার দেখতে চেয়েছিল তা কিছুটা হলে থমকে গিয়েছে।আর ক্যানিং নিয়ে আজ আমার কলমে তুলে ধরবো ইতিহাসের কিছু কথা।
ব্রিটিশ আমলে এক সময় পৌরসভার কৌলিন্য মর্যাদা পেয়েছিল ক্যানিং। পরাধীন ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ সুন্দরবনের উন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বন্দর। এই বন্দরে তৈরী হয় চালকল(রাইসমিল) নুনের গোলা। নানান কারনে ক্যানিং তার পৌরসভা তার অস্তিত্ব হারায়।সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কাকদ্বীপের এক সভায় ঘোষনা করে ছিলেন ক্যানিং পৌরসভা হবে। পুরাতন তকমা কে না ফিরে পেতে চায়। ফলে সেই আশায় বুক বেঁধেছেন ক্যানিংবাসী। প্রশাসনের কাছে ক্যানিংয়ে পৌরসভা তৈরী কোন খবরা খবর নেই। ফলে কিছুটা বিভ্রান্তীর মধ্যে ক্যানিংবাসী। যদিও তাঁদের আশা ক্যানিং পৌরসভা হলে এলাকার থমকে থাকা উন্নয়নের জোয়ার আসবে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে ক্যানিংকে পৌরসভার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে তা একটু অতীত ইতিহাসে চলে গেলেই বোঝা যাবে।মূলত ভৌগলিক কারণে বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা বাঁক নিয়ে মিশেছিল আঠারোবাঁকি ও করাতী নদীতে। তিনটি নদীর সংযোগ স্থলে সৃষ্টি হয়েছিল পর্বল একটি ঘুর্ণী। যা কিনা পরে মাতলা নদীর জন্ম দেয়। আর এই নদীর পাড়েই তৈরী হয় মাতলা গঞ্জ। বিভিন্ন সরকারি নথীতে যা মাতলা মৌজ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সয়মে কলকাতা বন্দর নাব্যতা হারাতে শুরু করলে বিকল্প হিসাবে ব্রিটিশদের চোখে পড়ে মাতলা নদীর পাড় এলাকা। অতীতের তথ্য অনুযায়ী সে সময় মাতলা নদী এতই খরস্রোতা ছিল যে ভাটার সময় বড় বড় জাহাজ অনায়াসেই নোঙর করতে পারতো মাতলা নদীর পাড়ে।জানা যায়, লর্ড ডালহৌসির আমলে ক্যানিং এ বন্দর তৈরীর কাজ শুরু হয়। ডালহৌসির পরে গভর্ণর হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং তাঁর আমলে কলকাতার সাথে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হয় মাতলা এলাকা। অন্যদিকে নদীপথে হলদিয়ার সাথে ও যোগাযোগের কাজ শুরু হয়। লর্ড ক্যানিং এর নাম অনুসারে মাতলা গঞ্জ বা মাতলা মৌজার নাম করণ হয় ক্যানিং টাউন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের সময়ে
১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে ভারতে প্রথম ভাইসরয়। বিখ্যাত রাজনীতিজ্ঞ জর্জ ক্যানিংয়ের তৃতীয় পুত্র চার্লস জন ক্যানিং। তাঁর প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের শুরু। লর্ড ক্যানিং এই বিদ্রোহটি দমন করেন এবং এ ঘটনার পর ১৮৫৮ সালে পার্লামেন্টারি আইন পাশ হয়। ক্যানিং যতদূর সম্ভব ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বাছবিচারহীন প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ পরিহার করেন এবং ‘ক্ষমাশীল ক্যানিং’-এর উপাধি অর্জন করেন। লর্ড ক্যানিং-এর প্রশাসনের শেষদিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাশ, যার দ্বারা বেসরকারি ভারতীয় সদস্যগণ ভাইসরয়ের আইনসভায় মনোনীত হতে পারতেন। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের সময়কার গুরুভার ও কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ক্যানিং অবসর গ্রহণ করে ১৮৬২ সালে ভগ্নস্বাস্থ্যে ভারত ত্যাগ করে চলে যান ইংল্যান্ডে। সেই থেকেই রয়েছে ক্যানিংসের ‘হাউস’, যা আজ প্রায় ধ্বংসাবশেষ।জরাজীর্ণ ভগ্নদশা বাড়ি কি আজও রয়েছে স্মৃতি হয়ে ক্যানিংয়ের বুকে। ব্রিটিশ আমলের ক্যানিং আজ পঞ্চায়েত পৌরসভা থেকে, মাতলা নদী তীরে গড়ে ওঠা শহরটিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজে লাগানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।এবং সুন্দরবনের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টাও করেছিলেন, ব্রিটিশদের সব স্বপ্ন আজ বিফলে। রাজনীতির ইতিহাস সে কথা প্রমাণিত,তবে বৃষ্টির মতন দীর্ঘ বছর রাজত্ব ভারতবর্ষের কোন শাসক দল করতে পারিনি। সেই সময় ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দিতে মাতলা নদীর তীরে ‘আধুনিক বন্দর’ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ‘লাটসাহেবের’ নির্দেশে সেই কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। জঙ্গল কেটে তৈরি হল নয়া কোম্পানির সদর দফতর, জনপদ। ইতিহাসের অধ্যায়ের টিঁকে থাকা স্মৃতি-বিজড়িত একমাত্র ভবনটি সংরক্ষণে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পদস্থ একদল অফিসার ঘটনাস্থলে যান। এরপর নির্বিকার চুপচাপ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো হেলদোল নেই আজও পর্যন্ত। সত্যিই কি লর্ড ক্যানিং এর বাড়ির সংস্কার হবে, এ প্রশ্নের বিশবাঁও জলে তলিয়ে গিয়েছে। তবে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?ক্যানিংয়ের এই বাসভবন ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিট পনেরো হাঁটাপথ। প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ। লোহার মূল ফটকটি বহুকাল আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। পুরু দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে এই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। বাড়ির দু’টি তল মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ঘর। কড়িকাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট। ভূগর্ভেও একটি তল আছে। একসময়ে সেটি ব্যবহৃত হত। বহুকাল ব্যবহৃত হয় না। বন্ধ করে রাখা হয়েছে একতলার বেশির ভাগ অংশ।বাড়ির দ্বিতলে ঘোষ পরিবার। এই পরিবারের দুই ভাইয়ের ছোটজন বুরন ঘোষের স্ত্রীর দাবি, “আমার শ্বশুরমশাই কোম্পানির লোকেদের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন। জেলাশাসক ও তাঁর লোকজন এসে দেখে গিয়েছেন বাড়িটি। আমরা বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য হস্তান্তরে সায় দিয়েছি দীর্ঘ বছর আগেই।”আজও সেই বাড়িটি সংস্কারের জন্য কোন উদ্যোগ নেননি সরকার। তবে সেই সময়ে ঘোষ পরিবারের এ দাবি সম্পর্কে অবশ্য সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের তরফে। এক পদস্থ অফিসার বলেন, “পূবে মাতলা নদী, পশ্চিমে ক্যানিং হাসপাতাল প্রায় সাড়ে সাতশ একর জমি ‘পোর্ট ক্যানিং কোম্পানিকে’ সরকার ইজারা দেয়।  খাতায় এই কিছুকাল আগেও গোটা অংশটি ছিল একটি বিশেষ (১০৪২) খতিয়ানে।” তাঁর দাবি, শুধু ওই বাড়ি নয়, গোটা অঞ্চলে পরবর্তী নানা সময়ে তৈরি বিভিন্ন বাড়ির আইনি মালিকানা নিয়ে ধন্দ ও সংশয় রয়েছে। সে সব নিয়মিতকরণের কথা ভাবা হচ্ছে। এই কারণেই সরকারি নথিতে ক্যানিংয়ের বাড়ি এবং সংলগ্ন জমি ‘খাসমহল’ হিসাবে চিহ্নিত ছিল। তাই ওই তল্লাটের জমি-বাড়ি কেনাবেচার আইনি ফাঁক ছিল কিনা আজও অজানা সবার কাছে। 

Related Articles

Back to top button