আমফান তান্ডবে বেহাল রাজ্য,সাথে বে-আবরু আমাদের শহর সভ্যতা।
শুভাশিস ঘোষ — কথায় আছে “প্রকৃতির মার দুনিয়ার পাড়”।প্রথমে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ তার সঙ্গে আমফানের যোগ।বলা ভাল একে রামে রক্ষা নেই সাথে বানড়রাজ সুগ্রীব।কি না ছিল না এবারের আমফান ঘুর্ণি ঝড়ে?ঘন্টায় ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার বেগে এই ঘুর্ণি ঝড় আছড়ে পড়ে গত ২০ মে।কোলকাতা ও দুই ২৪ পরগনায় যার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।বলা যায় অতীতের সব ঘুর্ণি ঝড়ের রেকর্ডকে ভেঙে দিল এবারের এই ঘুর্ণি ঝড়। সকালের দিকে দমকা হাওয়াই বলে দিচ্ছিল রাতের পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।তবুও আমরা যারা শহরবাসী অর্থাৎ কিনা সুবিধাবাদী নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ভেবে ছিলাম কোনক্রমে বেঁচে যাবে এই শহর।ঠিক যেমনভাবে অতীতে আমরা বারবার বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু সেটা যে এবার হওয়ার নয় সেটা বুঝতে পারলাম বেলা যতই গড়িয়েছে।বিকাল তিনটায় যা তান্ডবের চেহাড়া নেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি জীবনের দুটি ঘুর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা আমার মনে ভিষনভাবে আজো দাগ কেটেছে।যার একটা ২০০৯এর ২৫ মে আয়লা ঝড় এবং ২০১৯ এর ৯ নভেম্বর বুলবুল ঝড়। সেই আয়লা ঝড়ের গতিবেগ কোলকাতার রাস্তায় খুব একটা প্রভাব না ফেললেও গ্রাম বাংলা বিশেষ করে দুই ২৪ পরগণার সুন্দর বন প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। আয়লার তান্ডবে সেদিন সুন্দর বন সহ দুই ২৪ পরগণার বহু গ্রাম শহর সম্পুর্ণ ভেসে যায়।ক্ষতি হয় অসংখ্য ঘরবাড়ির মাঠের ফসল। গবাদিপশু সহ মানুষের মৃত্যুও আমরা এই ঝড়ে দেখেছি।যার জন্য প্রকৃতিকে যতটা দোষারোপ করা উচিত ছিল ঠিক ততটাই সরকারী প্রশাসনের অপদার্থতার কারণে এই দুর্ভোগ মানুষের আরো বাড়ে। যেখানে এই সময়কালে সুন্দরবন ঘুর্ণি ঝড় প্রবণ এলাকা বলে ইতিমধ্যেই সরকারী উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি ব্লকে এখন একটি করে ফ্লাট সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে ঘুর্ণিঝড়ের কারণে দুর্গতদের দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও এই অঞ্চলের প্রায় সবকটি স্কুল কলেজকেও দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তৈরি রাখা হয় যার পরিকল্পনা বহু আগে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন।ফলে ২০১৯ বুলবুল ঝড়ে সুন্দর বন অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ঘরবাড়ি চাষবাসের ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রাণহানির ঘটনা কিছুটা রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। বুলবুল ঝড়ের তান্ডব আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল কারণ ওই সময় আমি সাগর দ্বীপে ছিলাম।খবর করার তাগিদে সেদিন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সেই রুদ্রতাকে পরিলক্ষন করে মনে হয়েছিল আমার বুঝি নবজন্ম হয়েছিল।সে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতা বলা যায়।যা ভবিষ্যতে আর দ্বিতীয় বার পাওয়ার আশা কোনদিন করিনি। কিন্তু সেই সব অভিজ্ঞতাকেই চুরমার করে দিয়ে গেল গত ২০ মে সদ্য ঘুর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা। প্রথম থেকেই এই ঝড়ের প্রাবল্য সম্পর্কে আবহাওয়া অফিসের নানা রকম সতর্কতা বাণী মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বলেই ঠেকছিল।মনের মধ্যে আশা ছিল বিগত দিনের মতোই কোলকাতার রাস্তায় কয়েকটি গাছ পড়া ছাড়া আর তেমন কোন পার্থক্য দেখা যাবেনা। যেখানে শহরের পুরনো কিছু বাড়ির পাঁচিল ভেঙে দু একজনের মৃত্যুটাও স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া হবে এমনটাই মনে ভেবে ছিলাম। কিন্তু সকাল থেকে বাড়তে থাকা ঘুর্ণি ঝড়ের মাত্রা যখন বিকাল চারটে নাগাদ সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়ে বারবার আমার বাড়ির ইটের দেওয়ালে আছড়ে পড়তে শুরু করলো যার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো বাড়ির দেওয়াল কার্নিশ তখন বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি যে এই ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় দেড়শো কিলোমিটারের বেশি তো কম নয়।সত্যি বলতে কি বুলবুল ঝড়ে খোদ সাগর দ্বীপের চৌহদ্দিতে থেকেও যে ভয়ঙ্করতা উপলব্ধি করতে পারিনি এদিনে ঘরে বসে তার থেকে অনেক বেশি উপলব্ধি করেছি। আমাদের বাড়ির এ্যাসবেস্টার্স সিটের চালটি যখন মড়মড় করে উঠছিল তখন বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে পাশের বাড়ির কিছু উড়ে এসে পড়েছে।যা সেদিন মুড়িমুড়কির মতো আমাদের বাড়ির চালে আছড়ে পড়তে থাকে।ফলে ভেঙে যাওয়া এ্যসবেস্টার্সের ফাঁক দিয়ে তখন অনর্গল জলের ধারায় ঘর ভেসে যেতে লাগল। বিছানা চাদর জলে ভিজে সঁপসোপে। তখন এক অসহায় অবস্থা। সত্যি কথা বলতে সেদিনের ঝড়ের দাপট এতটাই অসহায় করে তুলেছিল পুরো পরিবার নিয়ে কোথায় একটু নিরাপদ আস্তানা পেতে পারি সেই চিন্তাই বারবার ছিঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু যখনই মনে হয়েছে সুন্দর বন অঞ্চলের নদীমাতৃক দ্বীপগুলোর অসংখ্য মানুষের কথা তখনই নিজের এই বিপর্যয়ের মুখেও সামান্য হলেও সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছি। এদিনে রাত নটার পর ঝড়ের তান্ডব খানিকটা কমতে থাকে যেখানে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা এক নতুন জীবনের জীব বলেই নিজেকে মনে হয়েছে।আর এরজন্য স্বীকারোক্তি করতে এতটুকু লজ্জাবোধ নেই তাহল আমার নাস্তিক মন এদিন পরমেশ্বর ভগবানণকেই একমাত্র এই মহা সংকটকালের উদ্ধার কর্তা হিসাবে বেছে নিয়েছিল। পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই গুটিগুটি পায়ে বেড়িয়ে পড়লাম শহরের পথে।বাড়ির বাইরে পা রাখতেই চোখে পড়লো ভয়ঙ্কর তান্ডবের বিভৎস দৃশ্য। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে মিলের চালে বিপদজনক ভাবে দুলছে বড়বড় টিনের সিট। সামনে রাস্তায় পড়ে আছে অসংখ্য ভারি সেই সব টিন ও বাঁশ।একটু এগোতেই ইলেকট্রিসিটি ল্যাম্প পোস্টের ভগ্ন দৃশ্য। তারপর যে পথেই গেছি চোখে পড়েছে গোড়া থেকে উপড়ে পড়া অসংখ্য গাছ সাথে ইলেকট্রিসিটির পোস্টগুলো। ভয়ঙ্করভাবে ঝুলছে বাতিস্তম্ভ যেকোন সময় বড়সর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। যেদিকেই নজর দিয়েছি শুধু ধ্বংসাত্মক ছবি।এতবড় প্রলয় নিঃসন্দেহে আমার জীবনে এই প্রথম।যা আমার ছাপান্ন অতিক্রান্ত জীবনে এক বড়সর অভিজ্ঞতার পুঁজি বলা যায়। ভোরের আলো ফোটার পরেপরেই এই দৃশ্য ক্রমেই আমার মনকে ভিষনভাবে নাড়া দিয়ে গেল, বারবার মনে পড়ছিল আমাদের সুন্দরবন এলাকায় সেইসব মানুষদের মুখ যাদের অস্থিমজ্জায় বেঁচে থাকার একটাই উপাদান সে শুধু প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই।আর সেই লড়াইটা যে এবারের আম্ফান ঝড়ে আরো কঠিন ছিল তা বুঝতে বাকি থাকল না যখন দেখলাম সুন্দরবন অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় থাকা আমাদের প্রতিনিধিদের মোবাইল ফোনের সুইচ অফ।বিপর্যয়ের শুরুর মহুর্তেও যারা আমাদের দপ্তরে খবর পাঠিয়েছেন ছবি দিয়েছেন সেই তাদের ফোনই বেলা দুটোর পর থেকে সম্পুর্ন নিশ্চুপ।বুঝতে অসুবিধা হয়নি অন্যান্যবারের মতোই সুন্দরবন এলাকায় নেট ওয়ার্ক বিকল হয়ে গেছে।তবুও অনেক চেষ্টা করে বিভিন্ন সোর্স থেকে যেটুকু খবর সংগ্রহ করতে পারছিলাম তার ভয়াবহতা জেনে শুধু আতঙ্কিত হয়েছি বলবো না বরং বলতে পারি এটাই ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা।সাগর দ্বীপের ধবলাট পরবেশ স্কুলে আগে থেকেই বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্হানীয় প্রশাসন।যারই কিছু ছবি পাই এদিনে ঝড়ের ঠিক পুর্ব মহুর্তে।কিন্তু বেলা তিনটে থেকেই কুলতলি,সাগর,নামখানা,কাকদ্বীপ সর্বত্র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।ফলে আমাদের পক্ষে আর নতুন করে কোন খবর যোগার করা সম্ভব হয়নি।যদিও ঘটনার প্রায় চারদিন পর কয়েকটি জায়গায় যোগাযোগ করে জানা গেল প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বেশ কিছু এন জিও ত্রাণকার্যে হাত মিলিয়েছে।যদিও তা চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য।যেখানে এই ঝড়ে সাগর,কুলতলি,নামখানার প্রভৃতি ব্লকে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে,বিঘার পর বিঘা চাষের জমি পানের বরোজ,পুকুরের মাছ ধ্বংস হয়েছে।বিদ্যুত বিহীন অধিকাংশ এলাকায় নেই সামান্য পানীয় জলটুকুও।যারই একই রকম চিত্র দেখা গেছে এদিনের পর খোদ শহর কোলকাতার কিছু কিছু অংশে।যদিও এইরকম ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্বেও প্রশাসনের ছিল নজরকারা উপস্হিতি।যাকেই সচল রাখতে রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী ২৪×৭ পাহাড়া দিলেন বলা যায় খোদ নবান্নে বসে।ছুটে গেলেন ২৩ তারিখ কাকদ্বীপে। বলতে দ্বিধা নেই এতটা এফোর্ট দেওয়া সত্বেও কিছু মানুষের বদবুদ্ধির কারণে পিছু ছাড়লনা রাজনীতি।যারই কারণে হল রাস্তা অবরোধ থেকে বিক্ষোভ ধর্না নানা প্রকার আন্দোলনের নামে অসভ্যতা।