আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবনে বনসৃজনের মোচ্ছব কাম্য নয়।
ড. স্বপন মণ্ডলের কলমে একটি চোখে দেখা এবং ঠেকে শেখা প্রতিবেদন
দূরদৃষ্টি পাতাটি পাঠকের কলাম এর জন্য ।পাঠকের নিজস্ব মতামতের জন্য সারাদিন কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়
আমফান ঝড়ে ম্যানগ্রোভের ক্ষতি হয়েছে এই কথা শুনে খুব বেশি হতাশ হচ্ছি না। কারণ প্রকৃতি নিজের ক্ষত নিজে সারিয়ে নিতে পারে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ঝড়ে উপড়ে যায় না তেমন। ডালপালা ভাঙে। ফলে কিছুদিন একটু মলিন হয়ে থাকে বটে, তবে কয়েক মাস না যেতেই নতুন শাখা-প্রশাখা ও পত্ররাজিতে আবার সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। মরিচঝাঁপিতে(১৯৭৮) বিরাট একটা এলাকা জুড়ে বন ধ্বংস হয়েছিল। ১৯৭৯ তে উদ্বাস্তুদের উঠিয়ে দেওয়ার পর মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ঘন জঙ্গল জন্মে যায়। এখন মরিচঝাঁপি অন্যতম ঘন অরণ্য। কেউ সেখানে বৃক্ষরোপণ করেনি কিন্তু। প্রকৃতির নিত্যদিনের খেয়ালি জোয়ার ম্যানগ্রোভের বিস্তার ঘটিয়েছে। বরং উদ্বাস্তুরা আসার আগে ঝাউ আর নারিকেল লাগিয়ে সরকার যে প্লাণ্টেশন করেছিল, তার কোন অস্তিত্ব মরিচঝাঁপিতে নেই। বলা যায় শুধুই সরকারি অর্থের অপব্যয়। (কেন হয়েছিল,কী উদ্দেশ্য ছিল জানি না। তবে উদ্বাস্তুদের আসার অনেক আগে প্লাণ্টেশন প্রকল্প একটি বাস্তব ঘটনা। ম্যানগ্রোভ কেটে নারিকেল ঝাউ লাগানো হয়।)আর একটি দৃষ্টান্ত দিই, ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনে যে ঝড় হয়েছিল, তার সর্বোচ্চ গতি রেডিওতে বলা হয়েছিল ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটার বা তার বেশি। যদিও গুগল বলছে গতিবেগ ২০৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা। এতো গতির ঝড় খুব কম ঘটেছে দক্ষিণ বঙ্গের ইতিহাসে। সমস্ত ম্যানগ্রোভের পাতা- ডাল ঝড়ের পর শুকিয়ে বিবর্ণ হয়েছিল। গবাদি,বন্যপ্রাণী এবং পাখির মৃত্যু ছিল অগণন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ঘন সবুজ অরণ্য আবার নিজের রূপ ফিরে পেয়েছিল। নিজের দেখা এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কথাগুলি। একারণে তথ্যসূত্র অনুল্লেখ। জোয়ার-ভাটাকে যদি স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়া হয় সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ বনসৃজনের জন্য পয়সা ব্যয় করতে হয় না। কিন্তু প্রতিবছর বনসৃজনের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয় -এটি বাস্তব ঘটনা। যতটা ব্যয় হয় তার অধিকাংশটিই বিশেষ কাজে আসে না। ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি, অর্জুন আর মেহেগনি লাগানোর ধুম দেখেছি কত! গরু-ছাগলের মুখ ছাপিয়ে যাহোক কয়েকটি বাঁচে, একটা আয়লা বা বুলবুল এসে সব মুছে দিয়ে যায়। আবার বৃক্ষরোপণের টাকা বরাদ্দ হয়। উৎসব হয়। অথচ প্রকৃতি নদীর চরে প্রতিদিন যে নতুন নতুন বীজ এনে নবজীবন সঞ্চার করছে, সেগুলিকে উপড়ে দেওয়া হচ্ছে পায়ের আঘাতে,ভটভটি যানের ধাক্কায়। এমনকি বন কেটে ফিসারি করে দেওয়ার ঘটনা বা রাস্তাঘাটের উন্নয়ন চলছে নিরন্তর । কিছুদিন আগে একটি নদী বেঁধে চাষজমি বাড়ানোর পরিকল্পনা শুনলাম এক জনপ্রতিনিধির মুখে। চর দেখা দিলেই নদীর উপর হামলে পড়ছে মানুষ। মাতলার বুকে তাকালেই উদাহরণ মিলে যাবে। ভোটার চাই, তাই রাজনৈতিক সমর্থন মিলে যায় দখলদারিতে। প্রচলিত ধারণা, বনসৃজন জরুরি, কিন্তু নদীকে বাঁচানো যেন জরুরি নয়। এই ভাবনাটাতেই সুন্দরবন এবং নদীবিধৌত সমস্ত অরণ্যের মূল ক্ষতি। নদীই যে ভাটিদেশে অরণ্যজীবনের জননী একথা বুঝতে চায় না কোনও প্রশাসন কিংবা উন্নয়ন। সুন্দরবনের বৃক্ষশূন্য নদীচরগুলিতে মানুষের চলাফেরা রদ করলে আপনা আপনি অরণ্য জন্মাবে, প্রকৃতি তার নিজের মতো তাকে সাজিয়ে নেবে। একথা কেউ বুঝতে চাইছে না। নদীসংলগ্ন চরে ধানিঘাস। তারপর বাইন -কেওড়া। এরপর গর্জন -কাকড়া-ধুধুল। একটু উঁচু মাটিতে হেঁতাল আর গরান ঘন ঝোপ হয়ে যাবে। নদী বাঁধের গা বরাবর গেঁওয়া গাছেরা যদি সৈনিকের মতো দাঁড়াতে পারে,সে বাঁধ ভাঙে কার সাধ্যি। কিন্তু তেমনটি হয় না। হবেও না। একটি গাছ পুঁততে কুড়ি থেকে ত্রিশ টাকা ব্যয় দেখানো হবে।#কংক্রিট বাঁধের দাবি ওঠা সংগত, কিন্তু ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর আন্তরিক দাবিও ওঠা দরকার। আমফান যে বাঁধগুলি ভেঙেছে তার চর বরাবর তাকালেই বিষয়টি বোধগম্য হবে।নদীর উপর অত্যাচার চলবে সারা বছর,অথচ ম্যানগ্রোভ নিয়ে অতি চিন্তাশীল হতে গিয়ে স্বাভাবিক বনকে কৃত্রিম করে তুলছি আমরা। ম্যানগ্রোভ বনসৃজন হোক। কিন্তু নদীর পলির চরিত্র বুঝে হেঁতাল বা গরানও জায়গা পাক। শুধু বাইন নয়, কাকড়া,গর্জন,পশুর সবাই জায়গা পাক। আর নদী চরের উপর দখলদারি বন্ধ হোক। প্রকৃতিকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়ে মানুষের বিকল্প জীবিকা দেওয়া হোক। নদীচরে নামা এবং হাঁটা- চলার উপর আরোপিত হোক সরকারি নিষেধাজ্ঞা।
ড.স্বপনকুমার মণ্ডল”নিজস্ব মতামতের জন্য নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।