শুভ জন্মদিবসে স্মরণ করি ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলিকে
ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলি (জন্মঃ-১৮ই জুলাই, ১৮৬১-মৃত্যুঃ- ৩ অক্টোবর, ১৯২৩) ভারতের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের অন্যতম এবং প্রথম ডিগ্রিপ্রাপ্ত মহিলা ডাক্তার। কলকাতায় জন্ম।তাঁর পিতা,বরিশালের অধিবাসী এবং সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজকিশোর বসুর অনেক সাহায্য এবং উৎসাহ পাওয়া সত্ত্বেও, কাদম্বিনীর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সহজ ছিলনা,কারণ তখন প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের মতো মেয়েদের কোনো বিদ্যালয় ছিলনা।তবে তাঁর শিক্ষার দরজা খুলে যায় ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড নামে একজন উচ্চশিক্ষিত ইংরেজ মহিলা কলকাতায় আসায়।মনোমোহন ঘোষ,দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, দুর্গামোহন দাস এবং অন্নদাচরণ খাস্তগিরের মতো ব্রাহ্ম বন্ধুদের সহায়তায় অ্যানেট পরের বছর সেপ্টেম্বর মাসে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় নামে মেয়েদের ‘উচ্চশিক্ষার’ জন্যে একটি স্কুল খোলেন। উচ্চশিক্ষা অর্থে বোঝানো হয়েছে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা।এ স্কুলের প্রধানশিক্ষক হন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, যিনি কিছুদিন মেয়েদের উপযোগী অবলাবান্ধব নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন(১৮৬৯)। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য হেনরি বিভারিজের সঙ্গে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড বিয়ের পর ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ায় এ স্কুলের অগ্রগতি তে ভাঁটাপড়ে,তবে প্রগতিশীল ব্রাহ্মরা ১৮৭৬ সালে এ স্কুলটিকে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ঠিক করেন যে, এ স্কুলে এন্ট্রেন্স পরীক্ষার জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুসরণ করবে।দু বছর পরে এ স্কুলটিকে অর্ধ-মৃত বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিলিত করে বেথুন স্কুল নামে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।পরের বছর এ স্কুল থেকে কাদম্বিনী মেয়েদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রেন্স পরীক্ষা দিয়ে তাতে উত্তীর্ণ হন।পরে তাঁকে নিয়ে শুরু হয় বেথুন কলেজ।১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী বসু নামে একজন খ্রিস্টান মেয়ের সঙ্গে তিনি বিএ পরীক্ষা দেন এবং তাঁরা দুজন সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই মহিলা-গ্র্যাজুয়েটে পরিণত হবার গৌরব অর্জন করেন।দু-বছর পরে চন্দ্রমুখী এমএ পাস করে নারীদের মধ্যে প্রথম এই কৃতিত্ব লাভ করেন।গ্র্যাজুয়েট হবার পর কাদম্বিনী চিকিৎসা-বিদ্যা অধ্যয়নের সিদ্ধান্তনেন,তবে তিনি যাতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে না-পারেন, তার জন্যে কলেজের কয়েক জন অধ্যাপক প্রবল বাধা দেন। এমনকি, তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাঁদের একজন তাঁকে এক মার্ক কম দিয়ে পরীক্ষায় ব্যর্থ করিয়ে দেন। তবে কলেজ থেকে তাঁকে একটা বিশেষ ডিগ্রি দেওয়া হয়,যাতে তিনি ডাক্তারি করতে পারেন।এন্ট্রেন্স পরীক্ষা দেওয়ার সময় থেকে তিনি সমাজের কাছ থেকে দারুণ বিরোধিতার মুখোমুখি হন, তবে বিরোধিতা বৃদ্ধি পায় তাঁর চিকিৎসা-বিদ্যা অধ্যয়নের সময় থেকে।ডাক্তারি করতে আরম্ভ করলে তখনকার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা বঙ্গবাসীতে তাঁর বিরুদ্ধে অপমানজনক প্রচারাভিযান শুরু করে এবং এবলে দোষারোপ করে যে,ডাক্তারি করার মতো যোগ্যতা তাঁর নেই। বঙ্গবাসী পত্রিকায় একটা কার্টুন এঁকে দেখানো হলো,ডাঃ কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাকে দড়ি দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী নন কাদম্বিনী কিংবা তাঁর স্বামী। মামলা হলো।বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের ১০০টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হলো।শেষ পর্যন্ত এ পত্রিকার সম্পাদক মানহানির জন্যে কারারুদ্ধ হলেওকাদম্বিনী এ প্রচারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ১৮৯৩ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেনে গিয়ে এডিনবরা, গ্লাসগো এবং ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিপ্লোমা লাভের দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন।ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একুশ বছর বয়সে বিপত্নীক এবং তাঁর সাবেক শিক্ষক ঊনচল্লিশ বছর বয়স্ক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে বিয়ে করেন।এতে হিন্দু সমাজতো বটেই,এমন কি, দ্বারকানাথের ঘনিষ্ঠ ব্রাহ্ম বন্ধুরাও ক্ষুব্ধ হন।ডাক্তার ছাড়াও তিনি ছিলেন সমাজসেবী এবং দেশপ্রেমিক।স্বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে ১৮৮৯ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বঙ্গদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তা ছাড়া,১৯০৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।আসামের চা-বাগানের এবং বিহারের কয়লা খনির নারী-শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যোতির্ময়ী ও সাংবাদিক প্রভাতচন্দ্র তাঁর দুই সন্তান।তাঁর মৃত্যু হয় ৩ অক্টোবর ১৯২৩।ক) তিনি প্রথম নারী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন।খ) ১৮৮০ সালে তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু প্রথম দুই নারী যাঁরা এফ. এ. পরীক্ষায় পাশ করেন।গ) তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮২ সালে ভারতীয় নারীদের মধ্যে (বৃটিশ অধিকৃত সকল দেশের মধ্যেও) প্রথম বি.এ পাশ করেন।ঘ) ১৮৮৭ সালে প্রথম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্র্যাক্টিস করার বিশেষ সার্টিফিকেট পান।ঙ) ভারত উপ মহাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনি-ই প্রথম (১৮৯৬ সালে) নারী যিনি বিদেশ থেকে মেডিকেল ডিগ্রী (এডিনবরা থেকে LRCP, LRCS , LFPS ডিগ্রী) অর্জন করেন।চ)কাদম্বিনী জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্যদের অন্যতমা।ছ) কংগ্রেস অধিবেশনে (১৮৮৯ সালে বোম্বাইতে) যোগ দেওয়া প্রথম দুই নারী প্রতিনিধির মধ্যে অন্যতম।জ) তিনি ছিলেন কংগ্রেসের কোন অধিবেশনে প্রথম নারী বক্তা ১৮৯০ সালে কলকাতার অধিবেশনে তাঁর ইংরেজি ভাষণ ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।।
-সংগৃহীত