ঘুর্ণি ঝড় আম্ফানের তান্ডবের জের
কোলকাতার কান্নায় ঢাকা পড়ে গেল গ্রাম বাংলার হাহাকার।
নিজস্ব প্রতিনিধি– একটা দুর্যোগের ও যে শ্রেণী চরিত্র থাকতে পারে সেটা বিশ্বাসই হতো না যদি না এবারের আমফান ঘুর্ণি ঝড় কোলকাতার উপর দিয়ে প্রবলভাবে বয়ে যেত।গত ২০ মে আমরা কোলকাতার শহুরে বাসিন্দারা আমফান ঝড়ে এতটাই পর্যদুস্ত হয়েছি যে আমাদের স্মরণ শক্তি সবই প্রায় এক প্রকার লোপ পেয়ে গিয়েছে বলা যায়।ফলে দুর্ভোগের শিকার হয়ে একপ্রকার দেওয়ালে পিট ঠেকে যাওয়া কোলকাতার কিছু অংশের বাসিন্দাদের আর্ত চিৎকারে এখন ঢাকা পড়ে গেছে গ্রাম গঞ্জের গরীবগুর্ব মানুষগুলোর কথা। প্রায় একশো শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন এই মানুষগুলোকে আমরা এক প্রকার ভুলেই গেলাম বলা যায়। বিগত দিনগুলোয় যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় এই শহর যেভাবে গ্রামের ওই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে এবারে তার পরিসংখ্যানটা খুবই কম। যেখানে বৃহত্তর কোলকাতার বেশির ভাগ অঞ্চলে দুর্যোগের পর থেকে তীব্র বিদ্যুতের অকাল তার সঙ্গে পানীয় জলের সংকট সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলা যায়।যারই সাথে রাজনীতি খানিকটা ব্যাথায় মলম যোগানোর মত কাজ করেছে বলা যায়।ফলে এখন নিত্যদিন শহরের কোথাও না কোথাও রাস্তা অবরোধ,ধর্ণা, বিক্ষোভের ছবি দেখা যাচ্ছে।আর সেই খবরে মেতে থাকা সংবাদ মাধ্যমের কাছে শহুর ছেড়ে গ্রামের কথা তুলে ধরাটাও এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে।মনে আছে ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়ের সময় আমি নিজে মাত্র চারদিনের মাথায় সুন্দর বন অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের দুঃখ দুর্দশার খবর করতে গিয়েছিলাম। সেই সময় দেখেছি কিভাবে সংবাদ মাধ্যম তাদের কথা তুলে ধরে এক নজির সৃষ্টি করা দায়িত্ব পালন করেছিল। যাদের পাঠানো খবরের পর বহু এলাকায় সরকারি তরফে ত্রাণ পৌঁছেছে শুধু তাই নয় আমাদের মত এনজিওরাও সেক্ষেত্রে সঠিক জায়গায় মানুষের জন্য ত্রাণ পৌঁছে দিতে পেরেছিল।যার অনেকটাই এবারে অদৃশ্য বলা যায়। যেখানে খবরটা যখন পণ্যের সমতুল্য তখন ঘরের পাশে জমাটি খবর ছেড়ে কে আর গা ঘামাতে ওই গন্ডগ্রামে যেতে চায়? কথা প্রসঙ্গে এমনই যুক্তির অবতারণা করলেন কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু। পেশাদার ওই সাংবাদিকের মতে আমাদের কাছে হাউসের খিদেটাই বড় ব্যাপার।সেখানে কোনটা খাবে আর কোনটা খাবেনা সে সম্পর্কে একশো শতাংশ নিশ্চিত না হলে খবর করাটাই বেকার যা হাউস নিতেই চাইবেনা।ধরুন কোলকাতার কোন আভিজাত্য এলাকার মানুষ রাস্তায় বসে বিক্ষোভে সামিল হচ্ছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ না কোনো গ্রাম বাংলার হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে রাস্তায় বসে আছেন সেটার গুরুত্ব বেশি? অবশ্যই সেলেবদের কথাই বেশি লোকে জানতে চাইবেন।কারন তাদের মধ্যে অনেকেই কবি সাহিত্যিক অথবা উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য সেখানে তাদের খবর করাটাই টি আরপি বাড়াবে।এতে খরচা কম লাভ অনেক বেশি। ঠিক যে কারনে এবারের আম্ফান ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডবের পর যতটা বেশি করে কোলকাতার রাস্তায় বিক্ষোভের চিত্র তুলে ধরা গেছে ততটাই বেশি অবহেলিত হল সুন্দর বন অঞ্চলের মানুষের দুর্দশার কাহিনী।এখানে যারা চার পাঁচ দিন বিদ্যুতের অভাবে সরকারের আদ্যোশ্রাদ্ধ করছেন তারা শুনে রাখুন সুন্দর বনের কুলতলি ব্লকের দেউলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেখানে নদীর নোনা জলে মাঠঘাট টোইটম্বুর,পানীয় জলের জন্য হাহাকার চলছে। বিদ্যুতের কোন চিহ্নই নেই। একদম প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাওয়া মানুষগুলোর ভয় এখন গ্রামে কখন বাঘ ঢুকে পড়ে মাতলা সাঁতরে।অতীতে যে গ্রামের অনেককেই টেনে নিয়ে গেছে ওই দক্ষিণারায়ন। ভাবুন সেই নিস্প্রদীপ গ্রাম বাংলার হাজার হাজার মানুষের কথা। যাদের হাহাকার শোনার সময় আমাদের নেই। কারণ সেটা খাবে না।কথা হচ্ছিল ওই গ্রামের ভুক্তভোগী সমতুল নস্করের সঙ্গে। প্রায় ছয় দিনের মাথায় যেটুকু কথা মোবাইলে বললেন তাতেই হৃদপিন্ড ছুঁয়ে গেল আতঙ্কের তরল স্রোত। বললেন,পুরো পঞ্চায়েতটাই এখন জলের তোলায়।ফলে নোনা জলেই সব কাজ সারতে হচ্ছে। গ্রামের ডিপ টিউবওয়েল সেটাও জলের তোলায়। বিদ্যুত নেই।কিছু প্লাস্টিকের ব্যবস্থা করতে পেরেছি শহরে একজন গেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে আসবে কিভাবে?সেই চিন্তা করছি।তার কথায় একটা মোবাইল চার্জ দিতে তিন কিলোমিটার রাস্তা ঠেঙিয়ে জেনারেটর সাহায্য নিতে হচ্ছে। ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বিলাশীতা বলে মনে হবে।তাই কোন ছবিও পাঠাতে পারছি না।ফোনের লাইনটা কেটে যাওয়ার আগে ওর একটাই কথা কানে এলো”দাদা একটু আমাদের দুরাবস্থার কথা তুলে ধরবেন প্লিজ,আমরা যে বড়ই কষ্টে আছি”। শুনে আর দ্বিতীয়বার কথা বলার চেষ্টা করিনি কারণ একজন শহুরে মানুষ হিসাবে নিজেকেই তখন বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল।