কোভিডের থাবায় বাড়ছে লকডাউন; ছেদ ধরছে বাঙালির আনন্দের দূর্গ্গোৎসবে
ঝুম্পা দেবনাথ ——–,:- দুর্গাপূজোর নাম শুনলেই বাঙালির মন আনন্দে নেচে ওঠে। কাশ ফুলের গন্ধ, ঢাকের শব্দ, ছোটদের নতুন জামা কেনার আনন্দ সব মিলিয়ে ঘরের মেয়ে উমার ঘরে ফেরার আনন্দে যেন সকলে মেতে ওঠেন প্রতিবছর। কখনো বড়ো প্রতিমা, আবার কখনো সোনার দুর্গা, এ সমস্ত কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। নতুন জামা-জুতো-ব্যাগ কেনার জন্য প্রতিবছর দোকানে মানুষের ভিড় জমে যায়। সব মিলিয়ে মনে হয় মা উমাকে চারটে দিন কাছে পাওয়ার আনন্দে মর্ত্যবাসী যেন প্রতিবছর সেজে ওঠে সাজ-সাজ রবে।
কিন্তু এবছর তো করোনার কালো ছায়া বাংলার আকাশকে গ্ৰাস করে ফেলেছে। দুর্গাপূজোর আর ১০০ দিন বাকি থাকলেও কারোর মনে কোন আনন্দ নেই, কানে ভেসে আসছে না ঢাকের শব্দ, নাকে ভাসছে না কাশ ফুলের গন্ধ। এবছর মর্ত্যবাসী দুর্গাপূজোর আনন্দকে ভুলে করোনার সংক্রমণের গ্ৰাফ কতটা উর্ধ্বমুখী হল, সেই দিকেই চোখ রাখছেন সকলেই। দিনে দিনে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। করোনায় আক্রান্তের দিক দিয়ে ভারত তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। প্রতিদিন করোনার সংক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে সকলেই আনন্দের হাসি মুখ ঢাকছেন মাস্কের আড়ালে। স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া বুলেটিন থেকে জানা যায়, ভারতে মোট সংক্রমণ প্রায় ১২ লক্ষেরও ছুঁই ছুঁই। করোনার প্রভাবে মৃত্যুর দিক দিয়ে ভারত বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।
এবছর কুমোরটুলির শিল্পীকলাদের চরিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো। গত বছরগুলিতে ঠাকুর গড়ার আনন্দে মুখে হাসির ছলকানি চোখে পড়া মুখগুলি যেন করোনার দরুন ঘন কালো কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে। গত বছরের কুমোরটুলিতে দেখা গিয়েছিল বিভিন্ন রকমের সারি সারি ঠাকুর, কত ঠাকুর রওনা দিচ্ছে দেশ বিদেশের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই বছরের কোলাহলপূর্ণ কুমোরটুলির চিএটা সম্পূর্ণই শুনশান।
কুমোরটুলির এক শিল্পী জানান, এই করোনার জন্য তারা ওর্ডার ছাড়া কোন ঠাকুর গড়ছেন না। ওর্ডার যা পাচ্ছেন তা সবই একচালার, বড়ো ঠাকুর করাতে চাইছেন না কেউই। আর অন্যবছরগুলোতে যেখানে প্রায় ১০০টার মতো বড়ো ঠাকুরের ওর্ডার পেতেন সেখানে ৪-৫ টা ছোট ঠাকুরের ওর্ডার পেয়েছেন, ফলত অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলেই জানাচ্ছেন তিনি। তেমনি অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন হস্তশিল্পের শিল্পীরাও। হাতিবাগান, শ্যামবাজার, খিদিরপুর প্রভৃতি মতো জায়গাগুলি যেখানে গত বছরগুলিতে খরিদ্দার ও বিক্রেতার কোলাহলে গমগম করত , এবছর সেই জায়গা শান্ত। আর্থিক সংকট থেকে বাদ যায় নি বাঁকুড়া, বীরভূম, মূর্শিদবাদের ঢাকি শিল্লীরা। প্রতিবছর এই পুজোর চারটে দিন ঢাক বাজিয়েই তারা সারাবছরের রোজগার করে থাকেন ,কিন্তু করোনার দরুন এবছরের চিএটি তো সম্পূর্ণ আলাদা। মূর্শিদবাদের এক ঢাকি শিল্পী জানান, করোনার জন্য পুজো কম হত্তয়ার দিক অনেক ঝুঁকছে বলেই ঢাক বাজানো ওর্ডার সেরকম পাননি,আবার ট্রেন করে কলকাতায় এসে করোনা সংক্রমণের ভয় নিয়ে ঢাক বাজ আসতেন চাইছেন না। তিনি আরও জানান বন্যার প্রভাবে চাষের শস্যও নষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। ফলত করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আর্থিক অনটনের মুখোমুখি হচ্ছেন বলেই জানাছেন। কেরালার সরকার জানান,কোন একটি জায়গায় বিপুল সংখ্যক মানুষ জমায়েত হলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও দ্রুতহারে বাড়ে , এই সংক্রমণকেই গোষ্ঠী সংক্রমণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। রাজ্যসরকারের পক্ষ থেকে বাংলার স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে জানান, কেরালার মতো এই পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়েছে গোষ্ঠী সংক্রমণ, তাই এই গোষ্ঠী সংক্রমণের চেনটাকে ব্রেক করার জন্য রাজ্যে সপ্তাহে দুই দিন সম্পূর্ণ লকডাউন করা হবে। তিনি আরও জানান, চলতি সপ্তাহে বৃহস্পতি ও শনিবার সম্পূর্ণ লকডাউন এবং আগামী সপ্তাহে বুধবার দিনটা লকডাউন করা হবে, আর আগামী সপ্তাহে লকডাউনের দ্বিতীয় দিনটি সোমবার বৈঠকে বসে ঠিক করা হবে। তিনি আরও বলেন, এই ভাবে সপ্তাহে দুই দিন করে আগস্ট মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ লকডাউন করা হলে, গোষ্ঠী সংক্রমণকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে বলে জানান। আবার অন্যদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, সকলকে সুস্থ থাকতে হবে তো সামনে দুর্গাপূজো। এখন সংক্রমণ কমাতে ক্লাবগুলি নিজ নিজ এলাকায় ভূমিকা নিক বলেই জানিয়েছেন।বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই আশ্বাসবানীতে পূজোপ্রেমিকরা অনেকটাই ভরসা পাচ্ছেন। অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় ক্লাব ভিত্তিক সংগঠন তৈরি করেছেন। সকলেই ঠিক করছেন বাজেট কমাতেছোট করেই পুজো সারবেন এবং সেই সঙ্গে ভাবছেন সামাজিক দূরত্ব যাতে বজায় থাকে তাই প্রবেশ পথে অনেকটাই জায়গা রাখতে হবে এবং স্যানিটাইজারের ব্যাবস্থা রাখবেন বলেও ভেবেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ তো মাস্ক ছাড়া পুজো মন্ডপে প্রবেশ নিষেধ বলেই জানাছেন।কিন্তু কোন কোন উদ্যোক্তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন দুর্গাপূজোতে যে বিপুল পরিমাণে ঢল নামে রাস্তায়, যেখানে যদি কোন মানুষ বিশেষজ্ঞদের থেকে জানা গোষ্ঠী সংক্রমণের প্রভাবে আক্রান্ত হন? তাহলে কি আরও উর্ধ্বমুখী হবে করোনার গ্ৰাফ? অনেক উদ্যোক্তারাই বলছেন, ঢাকিরা করোনায় আক্রান্ত হত্তয়ার ভয়ে আসতে চাইছেন না, তাহলে ঢাকের শব্দ ছাড়া পুজো হবে কি করে?—কোভিডের থাবায় বাড়ছে লকডাউন; ছেদ ধরছে বাঙালির আনন্দের দূর্গ্গোৎসবে——-