অধিকার
চিন্ময় সাহা
ভবঘুরের সম্রাজ্যের গুপী-বাঘা ভূতের রাজার কাছে খাওয়ার, পরার, আর যেখানে খুশি যাবার বর চেয়েছিল। কেননা রোটি-কপড়া-মকান এই তিন বস্তুর আয়োজন করতেই স্বাভাবিক ভাবেই দুনিয়া উৎসাহী। কিন্তু আছে কিছু সুস্থ ভবঘুরে তারা যেখানে খুশি যেতেও চায় না, পরার জন্যও না, শুধু মাত্র পেটের যোগান টুকু পেলেই হল।
যেখানে খুশি যাবার বদলে না হয় ভাবা যায় আপনার ঘর, কিন্ত সে অধিকারও এদের জোটে না। তবে অধিকার কি কেবল বাইরের বিষয়? এমনও হয়, মানুষের শরীর ব্যক্তিগত পরিসরের জন্য কিছু চায় না? নাকি চাইতে নেই?
এমনি ছিল এক ভবঘুরে সিধু, লোকে সিধু পাগল বলেই চিনত। সম্পদ ভাগ থেকে বঞ্চিত করতেই একদিন সংসার থেকে সবাই বিতাড়িত করেছিল, তাই সব ছেড়ে হতভাগ্য লক্ষ্মীছাড়া জীবনই বেছে নিয়েছিল! হিসেবে গোণা নেই তবু পেছনে অনেক গুলো বছর পার হয়ে গেছিল, আর অতীত বিরক্ত করত না। আক্ষেপ করে ভাবতে হত না “সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময় ছিল তার যৌবনকাল!” অন্যতম চাহিদা বলতে ছিল শুধু টিকে থাকাটাই চরম সার্থকতা, ঈশ্বর নামক একজন পক্ষপাতহীন বিচারক এর জন্য কিছু দোকান-পাট রেখেছিলেন, সিধু রোজ নিয়ম করে এদের কাছে আসতো, দুমুঠো জুটে যেত।
কখনো প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করলেও রোদ জল উপেক্ষা করে নির্বিকার চিত্তে সিধুকে চলতে দেখেছি নিয়মের কোনো পরিবর্তন হত না, হৃদয়ের দুর্মূল্য বস্তু হিসেবে সারাক্ষণ ধরে থাকত কাঁধের একটি পোটলা, মাঝে মধ্যে সেটি হাত বদলের সাথে কাঁধের পাশ বদলাতো, শরীরের পরিধান বলতে একটি অতিমলিন লজ্জা নিবারণের প্রায় অনুপযুক্ত ছেড়া ফাটা প্যান্ট, একটি জামা, পায়ে দুটো আলাদা রঙের একজোড়া চপ্পল থাকত। তার এই পরিধানিক চাহিদার যে অংশটা বেশভূষা হিসেবে লোকের চোখে পড়ে, পাগল নামকরণে ব্যাপারে সেইটুকুই যথেষ্ট হলেও কেবল সেইটুকুই সমস্ত ইতিহাস নয়। তার করুন চোখ মুখে এমন জবাব দিত, যেন মহাকালের দরবারে কোনো নীরব প্রতিবাদে বিচারের দাবী করত। এমনি করে আত্মবিসর্জন দিয়ে সে কি ঋণ পরিশোধ করত তা জানিনা।
যারা সিধুর পেট ভরনের যোগান দিত তাদের মধ্যেই একটা সুবোল দার চায়ের দোকান, সিধু সান্ধ্যকালীন চা পান করতে নিয়মিত আসতো,
মনে ভাবতাম, স্বাভাবিকত্বও তো আমাদের একটি আপেক্ষিক অবস্থা। তার উপরে নির্ভর করে সিধু কে অস্বাভাবিক বলার অধিকার আমাদের কে দিল! এক সন্ধ্যায় আমি এক সেট জামা প্যান্ট নিয়ে সিধুর অপেক্ষায় ঐ চায়ের দোকানে দাড়িয়ে, সিধু আসলে জিজ্ঞেস করলাম “তোমার নাম কি?”
বেশ মলিন মুখে মিস্টি হাসি মিশিয়ে জানালো “আমি সিধু, সিধু আচার্য।”
জামা প্যান্টের সেটটা এগিয়ে বললাম “এটা তোমার জন্য এনেছি এখন থেকে এটা পোরো….”
সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ গ্রহণ করতে করতে কিছু বলার অধিকার যেন সে হারিয়ে ফেলেছে
কিন্তু শ্রদ্ধা ও স্নেহের ভালোবাসা মন দিয়ে গ্রহণ করতে হয়, ফেরত দিতে নেই যেন সেইভাবে আমার হাত থেকে সেটি তড়িঘড়ি নিয়ে নিল, তারপর সেটিকে পোটলায় ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাবার উপক্রম করতেই বললাম চা খেয়ে যাও। ক্ষনিককাল অপেক্ষা না করেই সেদিনের চা খাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেই বলে উঠল “নাহঃ আজ আসি,” বলেই চলে গেল।
পরদিন সন্ধ্যায় চিরাচরিত পোশাকেই আবার সিধু কে পেলাম
জিজ্ঞেস করলাম “কই ঐ পোশাকটা পরোনি কেন?”
ভয়ে ভয়ে সিধু বলল “না বাবু ওটা পড়লে আমাকে সবাই চোর বলবে, অত সুন্দর পোশাক আমি পেলাম কোথায়? সবাই আমাকে মারবে, আপনি দিয়েছেন কেউ বিশ্বাস করবে না…..”
কেবল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি অবাক হয়ে ভাবলাম……
‘ওয়ার্ল্ড ইজ ইওর হাউস! তবুও যার সমস্ত অধিকার সমাজ সমুদ্রে পতিত, তার আর শুধু মাত্র চোর অপবাদ রক্ষার জন্য সমুদ্রের সঙ্গে গোল বাধিয়ে লাভ কি !!!’