বাড়ি আর ওদের ফেরা হলো না।
অভিজিৎ ঘোষ দস্তিদার
বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল ওরা। খবর ছিল ট্রেন ছাড়বে দূরের স্টেশন থেকে। ওরা ছিল বিশ বাইশ জন। জালনায় লোহার কারখানায় কাজ করে ওরা সবাই। গতর খাটিয়ে কাজ করতে হয়। শ্রমিক।
রাতের আঁধারে একসাথে এতগুলো লোক রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে পাছে সন্দেহ করে কেউ, তাই তারা ধরেছিল রেললাইনের সমান্তরাল দুটি রেখা। সারারাত ধরে হাঁটছিল ওরা। চাঁদনি রাতের মায়াবী আলোয় পায়ের তলায় এবড়োখেবড়ো পাথরও যেন মৃদু মোলায়েম। ঐ তো আর কতটুকু! আওরঙ্গাবাদে ট্রেন ধরলেই গাঁয়ের বাড়ি। ভাবলেই পায়ে জোর ফিরে আসে। গতি বেড়ে যায় হাঁটার।
তবুও পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। এ পথে সত্যিই কোনও চেকিং নেই। পুলিশ এসে পথ আটকায় না। টহলও দিচ্ছে না কেউ। তবুও ক্লান্তি শেষমেশ পাকড়াও করে ওদের। পা গুলো যেন অবশ হয়ে আসে। চোখের পাতা ভারি হয়ে নেমে আসতে চায়। সঙ্গে নিয়ে আসা জলের বোতল খালি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নাহ্! আর পারা গেল না। আর একটু পরেই পুবের আকাশ ফরসা হয়ে উঠবে।
“একটু জিরিয়ে নিলে হয় না হে!” হাঁকে দলের সবচাইতে বয়স্ক মানুষটি। “থামো সবাই খানিক। প্রায় এসেই পড়েছি, বুঝলে। ট্রেন তো সেই বেলার দিকে ছাড়বে। একটু বসি চলো কোথাও।”
“এখানে বসবে আর কোথায়! কোথায় কি আছে ঠিক নেই। একটাও ট্রেন তো এদিক ওদিক কোনও দিকে গেল না। এখানেই খানিক জিরিয়ে নাও। বিড়ি টিড়ি আছে কারও কাছে? আমারগুলো সব শেষ।” রেল লাইনের ওপর বসতে বসতে বলে দলের মুরুব্বি।
সব একে একে বসে পড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একটানা এতক্ষণ হাঁটছিল বলে বোঝা যায়নি, এবার বসতেই অসহনীয় ক্লান্তি পেড়ে ফেলে ওদের। হবে না! আধপেটা খেয়ে খেয়ে গায়ে বলও তো সেই আগের মতো নেই। তারপর অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা আর ভীতির ত্র্যহস্পর্শে মনের বলও তলানিতে ঠেকেছে। বসতে বসতে শুয়েই পড়ে ক’জন। এদিক ওদিক থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসতে থাকে অল্পক্ষণের মধ্যে। হাক্লান্ত অসহায় মানুষগুলির গায়ে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেন নিদ্রার দেবী। চিরশান্তির সেই অন্তিম ঘুম আর ভাঙেনি। চাঁদ ডুবে গেছে সবে। পুবের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে তখন। ভোরের আকাশে লাগল তাজা রক্তের ছিটে। মৃত্যু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল গাদেজালগাঁওয়ের মাটি। একটা উন্মত্ত দৈত্যর মতো ছুটে চলে গেল মানদাদের ঠিকানা লেখা মালগাড়ি।
দায় আরোপের, দোষারোপের পালা সাঙ্গ হলে আমরা হয়তো ভাবতে বসব। ভাবতে বসব এই তথাকথিত উন্নত সভ্যতা নিয়ে বড়াই করার যৌক্তিকতা নিয়ে। সভ্যতার রথের চাকাগুলি যাঁদের হাড় মাস দিয়ে তৈরি হল, তাঁদের কতটুকু সম্মান দিয়েছি আমরা! হকের পাওনা থেকে কেন বঞ্চিত থেকে গেলেন তাঁরা চিরকাল! এই হত্যাকাণ্ড কি স্রেফ একটি দুর্ঘটনা? এর পটভূমি কি আমরাই তৈরি করে দিইনি? এই অনাদর, এই তাচ্ছিল্য কি তাঁদের প্রাপ্য?
কেন ওঁরা রেললাইনে শুতে গেলেন? প্রশ্ন তুলবেন কিছু মানুষ। ওঁদের বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না। তাতেই বা কি আসে যায়, মশাই? দুদিন পরে তো সবই থিতিয়ে যাবে। শহীদের মর্যাদা তো ওঁদের কপালে জুটবে না!
নিজেকে ওঁদের জায়গায় নামিয়ে আনুন। একদিন ওঁদের যাপনে আঁচিয়ে দেখুন না, মনের ময়লা যত সাফ হয় কিনা।
ওঁদের পথ চেয়ে বসে থাকা মানুষগুলি পথের পানে চেয়ে বসে রইবেন বাকি জীবন। সেই পথে ধুলো উড়বে, শোকে ভারী হয়ে নেমে আসবে মাটিতে। ছানাপোনাগুলো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে চোখ মুছতে থাকা বড়োদের মুখের পানে। এই তারিখটা বেলাইন করে দিল কতগুলো জীবন। চিরকালের মতো।