আন্তর্জাতিক রাজনীতি অনেকের অজানা!
ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল যখন ট্রাম্প এক রিপোর্টারের একটি প্রশ্ন শুনে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে উত্তর দিয়ে দিয়েছিলেন। রিপোর্টারের প্রশ্ন ছিল আমেরিকা যে পৃথিবীর অন্য দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে তার জন্য অনেক দেশের পাল্টা ব্যবস্থার আশংকা ট্রাম্প করছেন কি? এই যেমন ভারত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানি পুরো বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ ওই সাংবাদিক ভারতের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমেরিকার চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি বন্ধ করার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেই দেখেছিলেন। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল : Sir. Are you worried about retaliation to your decision to ban export of medical goods, like Indian P.M.Modi’s decision to not export hydroxichloroquine to the US and other countries ?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তর ছিল : I don’t like that decision. I didn’t hear that, that was his decision. I know that he stopped it for other countries. I spoke to him yesterday. We had a very good talk and we’ll see whether or not that is. I would be surprised if he would, because India does very well with the United States. For many years they’ve taken advantage of the United States on trade. So I would be surprised if that were his decision. He’d have to tell me that. I spoke to him Sunday morning, called him, and I said, we’d appreciate your allowing our supply to come out. If he doesn’t allow it to come out, that would be okay. But of course there may be retaliation. Why wouldn’t there be ?( আমি এই সিদ্ধান্তটা পচ্ছন্দ করছি না। এটা তাঁর সিদ্ধান্ত বলেও শুনিনি। আমি এটা জানি যে কিছু দেশের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি গতকালই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। দুজনের মধ্যে খুব ভালো আলোচনাও হয়েছে। আমি খুব অবাক হবো যদি উনি এই সিদ্ধান্ত নেন কারণ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খুব ভালো। বহু বছর ধরে ওরা বাণিজ্য বিষয়ে আমেরিকা থেকে সুবিধা পেয়েছে। গত রবিবার সকালে আমি তাঁর সাথে কথা বলেছি। আমি ওকে বলেছিলাম আমরা আপনার প্রশংসা করবো যদি আপনি সরবরাহ চালু করেন। যদি তিনি সেটা নাও করেন কি আর করা যাবে। সেক্ষেত্রে আমরাও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারি। কেন নেব না?) এই শেষ দুটো লাইন নিয়েই যত বিতর্ক। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামের মাঝে ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক দুনিয়ায় আলোড়ন পড়েছে। আলোড়ন পড়েছে দেশের রাজনীতির আঙ্গিনায় এবং অবশ্যই এদেশের বিশেষত বাংলার চোখে আঙ্গুল দাদাদের মধ্যে।
একটা বিষয় স্পষ্ট, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে থেকে কোন বিবৃতি দেন নি। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এই কথা বলেন। আর প্রশ্নটাও ভুল ছিল। প্রসঙ্গত, সেই একই প্রেস মিটে ট্রাম্প যে সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিল ( এ বি সি নিউজের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা জোনাথান কার্ল) তাকে ‘থার্ড রেট রিপোর্টার’ বলে উল্লেখ করেন। এমনকি নিজের পচ্ছন্দের ফক্স নিউজ -এর সাংবাদিকদেরও ছাড়েন নি। ফক্স নিউজের সাংবাদিককে রীতিমতো কড়া গলায় ট্রাম্প বলেছেন : ‘You should say congratulations, great job instead of being so horrid in the way you ask a question.’ হুমকীপ্রিয় ট্রাম্প গত ০৮.০৪ ২০২০ তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও একটি হুমকী ঝেড়েছেন। তাঁর অভিযোগ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমেরিকার স্বার্থ একেবারেই দেখছে না। বরং চীনের স্বার্থ বেশী করে দেখছে। ভবিষ্যতে আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) এক পয়সাও আর দেবে না। যদি সত্যিই ট্রাম্প এই কাণ্ড করে বসেন তবে ভবিষ্যতে বিশ্ব জুড়ে আর এক সমস্যা তৈরী হবে। এই একই ট্রাম্প ০৬.০৪.২০২০ তারিখে ফক্স নিউজের সংবাদদাতা Sean Hannity -কে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন : ‘I bought millions of doses( of hydroxichloroquine). More than 29 million. I spoke to Prime Minister Modi, a lot of it ( hydroxychloroquine) comes out of India. I asked him if he would release it. He was great. He was really good.’ এহেন ট্রাম্পের একটা বাক্য নিয়ে যারা নেত্য করেন তারা হয় অশিক্ষিত কিংবা অর্ধপাগল।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্ক সার্বভৌম সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে একটি দেশ আর একটি দেশকে হুমকী দেবে তা আন্তর্জাতিক রীতি ও শিষ্টাচারসম্মত নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে যাদের সামান্য পড়াশোনা আছে তারা জানেন যে অধিকাংশ সময়ই সার্বভৌম সমতা একটি শ্রুতিমধুর শব্দ মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি বিশ্বরাজনীতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক আদালতে হেরে গিয়েও চীন দক্ষিন চীন সাগরকে নিজের এলাকা বলে দাবী করে গা জোয়ারি করে। আর আমেরিকাও আন্তর্জাতিক আইন শান্ত ছেলের মতো মেনে চলে এমন অপবাদ তার অতি বড় সুহৃদও দেয় না। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন কারণ ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবহে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতি ছিল দ্বিমেরুকেন্দ্রীক। আমেরিকার পাল্টা মহড়া নিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সব সময় তৈরী ছিল। ১৯৭১-৭২ এর ভারত পাক যুদ্ধে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এখনকার একমেরুপ্রবণ বিশ্বে ( যার নেতৃত্বে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প) লড়তে হবে একা। নিজের শক্তির জোরে। ভারত সেই শক্তি অর্জন করার চেষ্টা করে চলেছে। এগোচ্ছে দৃঢ পদক্ষেপে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত হুমকীর জন্য ভারত একেবারে বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিক এই ধাঁচের ভাবনা যাদের মনে আসছে তাদের এখন দরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে সামান্য একটু পড়াশুনো করা। নইলে ওই অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী হয়েই থেকে যাবে আর মাঝে মাঝে বিকটরূপে দেখা দেবে। ৫৬ ইঞ্চি তার কাজ করছে করুক। আপনারা একটু পড়াশোনায় মনোনিবেশ করুন। কারণ হাতে এখন প্রচুর সময়। আর একটা তথ্য জেনে রাখুন এই ৫৬ ইঞ্চি ছাতিই কিন্তু ২০১৮ সালের অক্টোবরে আমেরিকার হুমকী উপেক্ষা করে রাশিয়ার সংগে ৫.৪৩ বিলিয়ন ডলারের ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, যে চুক্তি অনুযায়ী ভারত রাশিয়া থেকে পাঁচটা S – 400 Triumf Surface – to – Surface Air Missile Defence System অর্জন করবে যা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। তখন আমেরিকার হুমকীকে পাত্তাই দেয় নি ভারত। অর্ধশিক্ষিত বাক্যবাগীশদের জন্য এই তথ্যগুলো দেওয়া হল। বিস্তারিত জানতে চাইলে আরো জানানো যাবে।এরকম আরো বহু উদাহরণ আছে।
বিশ্ব ব্যবস্থার এই ভয়ঙ্কর সংকট কালে ভারতের কিছু কাজ নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে এবং আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের মর্যাদাকে তা আরো অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। কিছু ভুল নীতি এবং মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে গোটা পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকা এখন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকটের আবর্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সংকট আর আসে নি। উপযুক্ত প্রতিষেধক আবিষ্কার করার আগে সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন -এর চাহিদা এখন ব্যাপক। আর ভারত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন -এর বৃহত্তম উৎপাদক। এই ওষুধের ৭০ শতাংশই ভারতে তৈরী হয়। উৎপাদন করে কিছু বিখ্যাত ভারতীয় ওষুধ উৎপাদক যেমন IPCA Laboratories, Zydus Cadila, Wallas Pharmaceuticals প্রভৃতি। ভারতে করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ার পর প্রথমেই এই ওষুধের রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ আভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিমাপ করার প্রয়োজন ছিল। ওষুধ উৎপাদক সংস্থাগুলো অতিরিক্ত উৎপাদনের ব্যাপারে তাদের সক্ষমতা জানানোর পরেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার স্পষ্টভাবে তার নীতিও জানিয়ে দিয়েছে। মানবিকতার খাতিরে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলিকে, বিশেষভাবে শ্রীলংকা ও নেপালকে। এছাড়া যে দেশগুলি সাংঘাতিকভাবে করোনা আক্রান্ত তাদেরও এই ওষুধ দেওয়া হবে। তবে অবশ্যই দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা যোগানের ভারসাম্য বজায় রেখে।
সুতরাং ট্রাম্পের হুমকী নয়, মানবিকতার খাতিরেই ভারতের এই সিদ্ধান্ত। বিশ্ব ব্যবস্থার বর্তমান সংকটের আবহে ভারতের এই সিদ্ধান্ত গোটা বিশ্ব নেতৃত্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অবশ্য চোখে আঙুল দাদারা এর বাইরে। তারা অবশ্য বাইরেই থাকে। তাই থাক নাহয় ।।