জীবন না জীবিকা কোনটার পিছনে ছুটবেন?
শুভাশিস ঘোষ–দাদা লক ডাউন আর কতদিন চলবে? সকালে ঘুম ভাঙতেই হাতের সামনে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠলো।হ্যাল বলতেই ওদিক থেকে ভেসে এল এমনই একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।মনে হল যেন আমিই এদেশে লক ডাউনটা ঘোষণা করেছি।যার শুরু থেকে শেষ সব কিছুর উত্তর একমাত্র আমারই জানা।ভাবুন দিনের একদম শুরুতেই যদি এমন একটা প্রশ্ন হঠাৎ করে উড়ে আসে আপনার দিকে যার সমাধানের বিন্দু বিসর্গ পর্যন্ত আপনার ধারণার মধ্যেই নেই তার উত্তর আপনি কি দেবেন ? বরং এসব প্রশ্নে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেজাজ হারাবেন।তাও আবার যদি এরকম দিনের একদম শুরুতেই হয়।অথচ সকাল থেকে রাত এরকমই এক প্রশ্নের মুখে বারবার পড়তে হচ্ছে যার কোনো উত্তর স্বয়ং নেতামন্ত্রী আমলাদেও জানা আছে বলে মনে হয়না।তবে পরিবেশ পরিস্হিতি বলছে যেভাবে গোটা বিশ্বজুরে করোনা ভাইরাস দাবানলের মতো একের পর এক দেশকে গ্রাস করে চলেছে তাতে ভারতবর্ষে এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়তে বাধ্য যা বলার অপেক্ষা রাখে না।যদিও এই লেখার সময় পর্যন্ত গোটা বিশ্বে করোনার কোপে প্রায় ৯৫,৬৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে,আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৬ লক্ষের বেশি।করোনা আক্রান্ত দেশের সংখ্যা এই মুহূর্তে ২১১টি।সবচেয়ে বেশী খারাপ অবস্হা ইতালি,স্পেন,আমেরিকার।বাদ যাচ্ছে না ইংলান্ড,জার্মানি,ফ্রান্সও।বরং সেই তুলনায় ভারতে জনসংখ্যার নিরীখে এপর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার দুটোই কম।যা ধরার মধ্যেই আসে না বলা যায়।গোটা দেশে এপর্যন্ত করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যাটা হলো ১৯৯,আক্রান্তদের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি।যা ভারতীয় জনসংখ্যার হিসাবে এক ভগ্নাংশেরও কম।আর প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে এখানেই ,তাহলে কি আমরা মাত্রাতিরিক্ত সাবধনতা নিতে গিয়ে আরো বেশি করে দেশের মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি?বাস্তবিক অর্থে এই লক ডাউনটা শেষ পর্যন্ত গরীবের ঘরে ঘোড়া রোগের মত হচ্ছে না তো? এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে অতীতের বেশ কিছু রোগের প্রদুর্ভাব দেখে।এর আগে ২০১৭ সালে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে “হু” ৩অক্টোবর তার সম্পর্কে সব দেশকে সতর্ক করেন, ২০১৮ সালে ব্রাজিলে ইয়োলো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়,তখনও বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হাটি এই রোগ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সব দেশকে সতর্কতা জারি করে,এর পর ২০১৯ এ অন্যতম মারাত্মক ইবলা ভাইরাসের কোপে পড়ে গোটা বিশ্ব সেটাকেও রোখা সম্ভব হয়ে উঠেছিল কারণ এই রোগের উৎপত্তি স্হল ছিল আফ্রিকার যে দেশগুলি ছিল তারা যথা শীঘ্র সম্ভব ব্যবস্হা নিতে পেরেছিল বলে।করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটা একেবারেই হয়নি বলা যায়।যেখানে মার্কিন সুপ্রীমো ডোনাল ট্রাম্প এখন সব দায় বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার ঘাড়ে যতই চাপানোর চেষ্টা করুন না কেন নিজের অপদার্থতার দায় তিনি কিছুতেই মুছতে পারবেন না।প্রশ্ন হল ৩১ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাস সম্পর্কে একটি প্রেস নোটে “হু” এই ভাইরাস যে চীনের উহান থেকে ছড়াতে চলেছে সে বিষয়ে বিশ্ববাসীকে সজাগ করেছিল।সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল,”A penemonia of unknown case dected in Wuhan,china was first reported to the who country office in China on 31st2019″
যদিও এই সতর্কবাণীকে কোনো ধার্তব্যের মধ্যেই সেদিন আনেনি গোটা বিশ্ব।বিশেষ করে এই সতর্ক বার্তাকে বেশ কিছু পশ্চিমের শিল্পোন্নত আর্থিক দিক থেকে বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকা সাবলম্বি রাষ্ট্রগুলি তো এক প্রকার হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।যা নিয়ে তখন যথেষ্ট সতর্কতা আমাদের দেশও নেয়নি।শুধু তাই নয় এই মারাত্মক করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষকে সজাগ করতে ২৪.৭ এর “হু”এ রোগ সম্পর্কে বিশ্লেষন,বিবরণ,পরামর্শদান সবই তারা করেছে।যেখানে ৩০ জানুয়ারী স্বাস্হ্য সম্পর্কিত জরুরী অবস্হা ঘোষণার পরামর্শও এই সংস্হার তরফে দেওয়া হয়েছিল।যেটাই আরো পরিস্কার করে তারা গত ১১ ফেরুয়ারী করোনা ভাইরাসকে কোভিড-১৯ ঘোষণা করেন।সুতরাং আজকে যে সকল দেশ করোনা ভাইরাসের প্রকোপের জন্য বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার ঘারে দোষ চাপাতে চাইছেন সেটা একদমই ঠিক নয়।অতি সংক্রামক এই ভাইরাসটিকে অবহেলা করে যারা নিজেদের পাপের বোঝা বাড়িয়েছেন আজ তারা দেশের মানুষের সামনে জবাব দিক কেন এই মারাত্মক ভাইরাসটিকে সমুলে ধ্বংস করার জন্য প্রথম থেকেই তারা সচেষ্ট ছিলেন না।আসল গল্পটা ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ার মতো মনে হবে।যেখানে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার তখন ব্যাস্ত ছিলেন এন আর সি, সিএএ,এনপি আর নিয়ে।কিভাবে এই দেশ থেকে মুসলিমদের তাড়ানো যায় তার প্যাচ পয়জার ছক ছিলেন। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা দেশের ছাত্রযুবদের মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়াটাই ছিল তখন রাষ্ট্রের আসু কর্তব্য।কখনো জামিয়া মিলিয়ায় হামলা তো কখনো জে এন ইউতে ঢুকে মারধর,আবার কখনো সাহিনবাগে দেশকো গাদ্দারদের গোলি মারার ঠেকা নেওয়া গোমূত্র পানকারীদের আস্ফালন।এরই মধ্যে দিল্লির বিধানসভা ভোট।গো হারা হেরেও না থামার পাত্ররা বাদিয়ে দিলেন জোর দাঙ্গা।পুড়লো হাজার হাজার মানুষের ঘর বাড়ি মন্দির মসজিদ।ফেরুয়ারী মাসের ২৫ থেকে ২৮ তারিখ তিনদিনের সেই দাঙ্গায় মৃত্যু হল সরকারি হিসাবে ৫৩ জন।আর বেসরকারি তো তিনশোর উপর।লুট, ঘরদোরে অগ্নিসংযোগ সব মিলিয়ে কয়েকশো হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি খোয়ালেন সাধারণ গরীব মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ।অথচ এই সময় থেকেই কোভিড-১৯ তার ধারক বাহকদের সংখ্যা যে ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে তার দিকে কারোর কোন নজর ছিল না,বরং সেই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ১০০ কোটি টাকা বাজেটের ভারত সফরকে যথা সম্ভব জৌলষমুখোর করতে কোথাও পার্ক সাজিয়েছি তো কোথাও গরীবি ঢাকতে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা জুরে পাঁচিল তুলেছে।।এর পরেও মার্চ মাসের প্রথম দুটি সপ্তাহ আমাদের দেশের জণজীবনে এতটুকু কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না।আমরা বুঝলাম আর সব দেশের মত আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস তেমন প্রভাব ফেলবে না যতটা চীন, ইতালি,ফ্রান্স,স্পেনে হয়েছে।মাহামহিম প্রধাণমন্ত্রীর মুখ থেকে এই সময়কালে দেশবাসী একটি শব্দও করোনা ভাইরাস সম্পর্কে শুনতে পায়নি।অথচ তখন বিশ্বজরে প্রায় একশোর উপর দেশে মানুষের মৃত্যু মিছিল শুরু হয়ে গেছে।আমাদের দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রবিদরা কেন তখনো এনিয়ে সক্রিয়তা দেখালেন না? আজ যারা চ্যানেলে চ্যানেলে রোজ নিয়ম করে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে আসছেন তারা কেন ফেব্রুয়ারী মার্চেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আরো বেশি বেশি করে সোচ্চার হলেন না? নাকি অতি সাবধাণ বাণী আওড়ালে রাজার কোপানলে পড়বেন সেই ভয়ে? যেখানে বহু দেরিতে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা আমার দেশের সামনে আজ সার্বিক লক ডাউন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এমন ধারণা থেকেই বর্তমান দেশের রক্ষকরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।প্রশ্ন তো উঠবেই একশো সাঁইত্রিশ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে মানুষের মৃত্যু মিছিল রুখতে লক ডাউন কি আদৌ আশীর্বাদ হবে নাকি আরো বড় মৃত্যু মিছিলের অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।একটা পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে যথেষ্ট হতে পারে,এপর্যন্ত লক ডাউনের এই আঠারো , কুড়ি দিনে আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষের মোট মৃত্যুর সংখ্যা হল দুশো (এই লেখার সময় পর্যন্ত)।যেখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাটা হল পাঁচ হাজারের কিছু বেশি।যার শতাংশের হিসাবে এক ভগ্নাংশের নীচে বলা যায়।আর এই সময় অন্যান্য সাধারণ সময় আমাদের দেশে রোজ স্বাভাবিক মৃত্যু হার কত থাকে? যেখানে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকেই উঠে এসেছে এদেশে ফসলের দাম না পেয়ে কৃষক মৃত্যুর হার রোজ কয়েকশো হয়।বাচ্চা তার অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের আগেই মারা যায় সেই সংখ্যাটা চার হাজার।প্রতিদিন অপুষ্টির কারণে মা তার প্রসূতিকালীন সময়ে মারা যায় সেই সংখ্যাটাও কিছু কম নয়।এর সাথে আছে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু থেকে দেশের নানা প্রান্তে দাঙ্গা হাঙ্গামা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যুর সংখ্যাটা। যেখানে ভারতে রোজ জন্মের হার ৮৫ হাজারে কিছু বেশি কিন্তু মানুষের মৃত্যু হয় ৬৫ হাজারের মতো।যা প্রমাণ করে এই দেশ আগামী দিনে জনবিস্ফোরণের দরজায় পৌছে যেতে চলেছে।তাই যেটা আজ সবচেয়ে বেশি করে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন তাহল জীবন না জীবিকা কোনটাকে আমরা আজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব।বহু বছর আগে কবিগুরু তার কবিতায় হাবুচন্দ্র রাজার দেশে গবুচন্দ্র মন্ত্রীর উল্লেখ দিয়ে গিয়েছিলেন।যেখানে রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীটি নাকি বুদ্ধি বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে দেহের সব ফুটোতে একটা করে তুলো গুজে দিতেন।আর তাতেও নিশ্চিত হতে না পেরে নিজেকে লোহার সিন্ধুকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিতে বলতেন।রাগ করবেন না,লক ডাউনের ফেরায় পড়ে আমরা সেই রকম গবুচন্দ্র মার্কা রাজার প্রজাকুল হয়ে যাচ্ছি না তো? রাজা হাসলে আমরা হাসছি,রাজা কাঁদতে বললে আমরা কাঁদছি,রাজা আমাদের ঘন্টা কাঁসর বাজাতে বললে তাও বাজাচ্ছি।মোমবাতি,হ্যারিকেন জ্বালাতে বললে তাও করছি মহা আনন্দে।কিন্তু একবারোও কেউ প্রশ্ন তুলে বলছি না কেন রাজা করোনার বিরুদ্ধে এত দেরিতে যুদ্ধ শুরু করলে?কেন জানুয়ারী মাস থেকেই ধাপে ধাপে দেশকে লক ডাউনের পথে নিয়ে গেলে না?কেন এই দেশের আন্তর্জাতিক উড়ানগুলো বন্ধ করতে গত ২৭ মার্চ পর্যন্ত সময় নিলে?কেন কোভিড-১৯ বিষাক্ত এই সংক্রমণের সাবধান বাণী শুনেও দেশের ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই,হাসপাতাল,নার্স ডাক্তার স্বাস্হ্যকর্মীর মজুত ভান্ডার গড়ে তোলা গেল না?আমরা কেন শুধুই পশ্চিমা দেশ আর আমেরিকার মুখাপেক্ষি হয়ে বসেছিলাম?যেখানে সোয়াশো কোটি মানুষের এই দেশে যেখানে সত্তর শতাংশ মানুষ রোজ দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়না।এক কোটি সাতাত্তর লক্ষ মানুষের রাত কাটে রেল স্টেশান,ফুটপাতে কিংবা জলের পাইপের ভিতর সেই দেশের একজন প্রধাণমন্ত্রীর দায়িত্ববোধ তো আরো প্রখর হওয়া উচিত ছিল।নাকি হবুচন্দ্র রাজা শুধু তার গবুচন্দ্র পার্ষদদের নিয়েই ভাববেন।যে পার্ষদরা সকাল থেকে সন্ধ্যা রাজার স্তোকবাক্য পাঠ করেই ধন্য হয়ে যান।যাদের দুবেলা উদরপুর্তির পর স্বপ্নীল রাষ্ট্রভক্তির রোদ চশমায় চোখ ঢেকে রামরাজত্বের স্বপ্ন দেখেন,যাদের চোখে প্রকৃত অর্থেই ধরা পড়ে না বুভুক্ষার ভারতবর্ষ।লক ডাউনের এই কর্মনাশা দিনেও যাদের সংসার চলে গরীবের হাড় মাংসের উপর জমানো পুঁজিতে।আজ তারাই হলো লক ডাউনের সবচেয়ে চড়া সমর্থক।আশা করবো একদিন লক ডাউনের এই অনন্তকাল ভেঙে মানুষ তার জীবিকার খোঁজে রাষ্ট্রের সব ভ্রুটিকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসবে,সোচ্চারিত কন্ঠে বলুক জীবন নয় জীবিকাই বড়।জীবিকা হারিয়ে জীবন যেন সোনার পাথর বাটি।আদপে এটা বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় যড়যন্ত্র।যা শুধু গরীবের প্রাণ কেড়ে নেবে বড়লোকদের নয়।