মহালয়া মানেই দুর্গা পুজোর দিন গোনা শুরু
মৃত্যুঞ্জয় সরদার:আজ মহালয়া,মহালয়া মানেই দুর্গা পুজোর দিন গোনা শুরু হয়ে যাওয়া। বর্তমানে অবশ্য মহালয়া থেকেই পুজোর শুরু হয়ে যাওয়া। এবছরের মহালয়া একমাস পরে দেবী দূর্গা মায়ের আগমন হবে।তৎকালীন সময়ের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তারা এই নীতিটা এমন দিন আসবে ভাবতে পারেনি।আজকের দিনের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অবাক হচ্ছেন, অবাক হয়ে যাচ্ছে ,যে কারণে ঠিক এক মাস পর দুর্গাপুজো এটা সপ্নে ভাবতে পারেনি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। তাদের মধ্যে কানাঘুষো গুঞ্জন রটেছে কি কি দিন এলো রে বাপু ,সেই কারণে কি আজ এই করোনাভাইরাস এ মানুষ বিপদগ্রস্ত। ভগবান কাউকে ক্ষমা করছে না, এ নিয়ে কুসংস্কারের কল্পনা জল্পনা শুরু হয়েছে গ্রামগঞ্জে
মহালয়ার দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়া কথাটির বিশেষ অর্থ রয়েছে। ও মহল আর একমাস পরে দুর্গা পুজো হচ্ছে, এজে কেমন দিন পৃথিবীকে ধ্বংস ইঙ্গিত দিচ্ছে! কল্পনা জল্পনা যাই থাকুক না কেন এবছরের সত্যি মহালয়ার ঠিক এক মাস পরে দেবী দুর্গার আগমন। পিতৃপক্ষের অবসান বা দেবীপক্ষের পূর্ববর্তী অবস্হাকে বলা হয় মহালয়া। এই ব্যাপারে অবশ্য মতান্তর রয়েছে মহ শব্দটির অর্থ মানে পূজা, আবার মহ বলতে উৎসব ও বোঝায়। এছাড়া মহালয়া বলতে বোঝা যায় মহান ও আলয় নিয়ে মহালয়। এর সঙ্গে আ যোগ করে পূজার আলয়। আলয় শব্দের অর্থ আশ্রয়। আবার মহালয় বলতে বোঝা যায় পিতৃলোককে, যেখানে স্বর্গত পিতৃপুরুষদের অবস্হান। এই দিন হল তর্পণের দিন বা পিতৃপক্ষের শেষদিন। বাঙালী হিন্দুদের কাছে যে বিষয়টির জন্য মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম সেটা হল, মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্রপাঠ শোনা। এর মাধ্যমেই শুরু হয় বাঙালীর দুর্গাপূজা। এই একটি ঐতিহ্য বাঙালি আজও সমানভাবে বহন করে চলেছে। সেই অর্থে দুর্গাপুজোর আভাস মেলে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বিশেষ বেতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই। এইদিনে অনেকেই তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে বা তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গঙ্গায় বা অন্য নদীতে তর্পণ করেন অনেকে। পিন্ড দান বা শ্রাদ্ধের মতো আচার অনুষ্ঠান করা হয়। পূর্বপুরুষদের তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল দান করা হয় এবং তাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদান করা হয়। সাধারণভাবে মৃত পূর্বপুরুষগণকে জলদান করাকেই তর্পণ বলা হয়। মহালয়া তর্পণের মধ্যে দিয়েই অবসান হয় পিতৃপক্ষের। আর, সামনে যেহেতু দুর্গাপুজো, তাই তারপর থেকেই বাঙালীর দেবীপক্ষ শুরু হয়। বর্তমানে বদলেছে বাঙালির জীবন। পছন্দ, ভালোলাগা মন্দলাগা। কিন্তু আজও এই একটি বিষয়ে বাঙালি ভীষণ প্রাচীনপন্থী। মহালয়ায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ছাড় নেই। এব্যাপারে শহর এতটাই স্পর্শকাতর যে মহানায়ক উত্তমকুমারকেও পর্যন্ত রেয়াত করেনি। ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থার সময় মহানায়ক এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ওপর দায়িত্ব বর্তেছিল এই অনুষ্ঠানের। বাঙালি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেদিন। মহানায়কের বাড়িতে নাকি ঢিল ছোঁড়া হয়েছিল। অভিমানে-অপমানে আকাশবাণী ছেড়ে দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। সুপারফ্লপ সেই সম্প্রচারণ শুনে বোধদয় হয়েছিল বেতার জগতের কর্মকর্তাদের। সসম্মানে ফের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বীরেন্দ্র কৃষ্ণকে। মহানায়ক নিজে বীরেনবাবুর বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন তাঁর কাছে। ১৯০৫ সালে আহিরিটোলায় কালীকৃষ্ণ ভদ্র-সরলাবালা দেবীর কোলে জন্মেছিলেন যে বীরেন, কে জানত একসময় তিনিই হয়ে উঠবেন মহালয়ার বঙ্গ জীবনের অঙ্গ!তবে মহালয়ার পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পূর্বপুরুষের মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়। এই কারনে রামায়নে অনুসারে ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে দেবী দূর্গার আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজো বসন্তকালে হওয়াই নিয়ম। শ্রীরামচন্দ্র অকালে দুর্গাপুজো করেছিলেন বলে একে অকাল বোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজের আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। লঙ্কা বিজয়ের আগে এমনটাই করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সেই থেকে মহালয়ায় তর্পণ অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলিত।তবেই মহাভারতে অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মহাভারত অনুযায়ী, মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।তাই আজ ভারত ভূমিতে কোটি কোটি মানুষ মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে ‘ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্তু’- এই মন্ত্র উচ্চরণ করে তিন গন্ডুষ জল অঞ্জলি দিয়ে বিদেহী পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে চলেছেন। গয়ায় মহালয়া উপলক্ষ্যে পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে। এছাড়া মহালয়ার ভোরে চন্ডীপাঠের রীতি রয়েছে। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে বারাণসী বা গয়ায় গিয়ে দ্বিপ্রহরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।