মাওচিন্তাধারা আর আমরা যাকে মাওবাদ বলছি তাও এক নয়।
মৃত্যুঞ্জয় সরদার:লেখাটি শুরু করার আগে নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে না ধরলে, লেখাটি মনোযোগ বসানো সম্ভব নয়। ২০০৬ সাল থেকে আমি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হয়ে, প্রথমে কাজ শুরু করি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকেই।সেখানে কাজ করতে করতে একটা অনুভূতি নিজের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, অন্যায় বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার চাবিকাঠি হচ্ছে মাওবাদ।জঙ্গলমহলের মানুষের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে একমাত্র মাওবাদী আর সেই নীতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল ,জঙ্গলমহলে কিষানজী।রাজনীতি শোষণ-নিপীড়ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল অসহায় পেঁপে ডিম খাওয়া আদিবাসী মানুষগুলো।জঙ্গলমহলের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মাওসেতুং এর নীতি তাকে অন্যভাবে বিবর্তন হয়েছিল।রাজনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এটাই তাদের কাছে মূল চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর যাই হোক আজকের যে শোষণমূলক সমাজে আমরা বাস করছি তা একসময় অস্তিত্বমান ছিলনা। আদিম সাম্যবাদী সমাজে কোন শোষণ ছিলনা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ছিল সমান। যৌথভাবে সবাই কাজ করতো আর কাজের ফল সমভাবে তা সবার মধ্যে বন্টিত হতো। পরবর্তীতে যখন মুষ্টিমেয় কিছু লোক যারা ছিল গোত্রপতি, বিভিন্ন সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিপত্তি ও সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ব্যাপক অধিকাংশ মানুষকে দাস বানিয়ে ফেলল তখন থেকেই শ্রেণী সমাজের উদ্ভব ঘটলো। শোষণের এ ধারা বজায় থাকে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও বর্তমান পুঁজিবাদী স্তরে। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সর্বপ্রথম দেখান যে সমাজের শোষিত শ্রেণী সর্বহারা শ্রেনী এই পুঁজিবাদী সমাজকে ভেঙে ফেলবে আর গড়ে তুলবে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ। আর সেই লক্ষ্যেই মাওবাদ, মালেমা, প্রধানত মাওবাদ সবই হচ্ছে সংশ্লেষন। কিন্তু আমরা জানি, সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ হচ্ছে একই বস্তুর দুই দিক। এর মধ্যে সংশ্লেষণ হচ্ছে প্রধান। কিন্তু এটাও একটা অন্তহীন প্রক্রিয়া। মালেমাকে সংশ্লেষিত করে বলা হয় মাওবাদ, আবার মালেমাকে বিশ্লেষণ করে নতুন সংশ্লেষণ, প্রধানত মাওবাদ। তবে, সংশ্লেষণ বলেন আর বিশ্লেষণ বলেন সবই প্রয়োজন থেকে। সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেনীসংগ্রামের স্বার্থেই এসবকিছু।এর জন্য একশ্রেণীর মানুষ জীবন দিতেও রাজি হয়ে গেছিল মাও সেতুঙের বাহিনীতে ।তবে ভারতবর্ষের রাজনীতি তথা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসবাদের রচয়িতা যার মধ্যে মার্কসের ভূমিকা প্রধান। লেনিন ও স্তালিন লেনিনবাদের রচয়িতা যার মধ্যে লেনিনের ভুমিকা প্রধান। তিনি পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে মূর্ত করেন এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই নিশানাবদ্ধ করেন। তার উপলব্ধি ছিল এই যে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়ারা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এবং আধা-সামন্তবাদের প্রতিনিধি। এটাও হচ্ছে একটা নির্ধারক চিন্তা যা আজকের বিশ্ব কমিউনিস্টদের অতি অবশ্যই বুঝতে হবে।আমরা আদর্শ নীতি ভুলে গিয়ে বর্তমান রাজনীতি তা ক্ষমতার লড়াই , ভোগ বিলাসিতা এর দিকে এগিয়ে চলেছে।সাধারণ মানুষের উপরে নির্মম অত্যাচার করে, নিজে কত টাকার মালিক হওয়া যায় আর সমাজের চোখে সমাজসেবী হওয়া যায়। বর্তমান রাজনীতিতে এটাই চলছে। তবে বহু যুগের চীনা গণতান্ত্রিক ও জাতীয় বিপ্লব, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংগ্রাম এবং সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় মাওসেতুঙ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে এক সম্পূর্ণ নতুন স্তরে উন্নীত করেন তা হচ্ছে মাওবাদের স্তর। আজকের যুগে যেভাবে রাজনৈতিক নেতারা মন্দির মসজিদ গির্জা মানে না। কঠোরভাবে অবিচার করছে একশ্রেণীর নম্র-ভদ্র মানুষের উপরে,তৎকালীন সময়ে এইরকম ভাবে অত্যাচার অবিচার অনাচার করেছিল মার্কসবাদ লেলিনবাদ আর সেই কারণেই মাওবাদের জন্ম। মাওবাদী আদর্শ নীতি নিয়ে আজকেরে যুগের মানুষেরা মাওবাদী হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচার অবিচার কারণে ,সঠিক বিচার না পাওয়ার কারণে আজকের যুগের মাওবাদীদের আবার উদঘাটন হচ্ছে।জঙ্গলমহলের মাওবাদীরা আজও টিপটিপ করে জ্বলছে তাদের সংগঠনগুলো। তবে তৎকালীন যুগের মাও ইতিহাসে আজও বহু লেখোকের লেখনিতে প্রকাশ পেয়েছে, আর সে কথাই আজ আমি আমার কলমে তুলে ধরছি।মাও, সিরাজ সিকদার, চারু মজুমদার, গনসালো…থেকে আমরা পেয়েছি মাওবাদ, যাতে মাওয়ের ভুমিকাই হচ্ছে মুখ্য। সার্বজনীনতা এমনি এমনি হয়না, সেটাকে অর্জন করতে সংগ্রাম করতে হয়, তার স্বীকৃতির জন্যও সংগ্রাম করতে হয়।আসুন আমরা একটু বিস্তারিতভাবে দেখি সিরাজ সিকদারের চিন্তা ও কর্মকে। সিরাজ সিকদার হচ্ছেন বাংলাদেশের মহানতম সন্তান যিনি এখানে সর্বহারা শ্রেণীকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশ হিসেবে মাও চিন্তাধারাকে হাতে তুলে নিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই ভিত্তিতে তিনি সঠিকভাবে পূর্ববাংলার সমাজকে ঔপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী হিসেবে বিশ্লেষণ করেন এবং সর্বহারা শ্রেণীকে নেতৃত্ব দেন তাঁর নিজ পার্টি গড়ে তুলতে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাঁর বাহিনী গড়ে তোলায়, কৃষক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীকে সমাবেশিত করার মাধ্যমে য্ক্তুফ্রন্ট গঠনে। তাঁর নেতৃত্বে পার্টি দুইবার ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলায় সক্ষম হয়ঃ একবার বরিশাল জেলার বদ্বীপের পেয়ারাবাগান অরণ্যে, আর পরবর্তীতে ’৭২-’৭৫ সময়কালে পার্বত্য চট্রগ্রামে। তাঁর এই ধারণার আন্তর্জাতিক তাৎপর্য ছিল যে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং পরবর্তীতে ভারতের উপনিবেশ। সেই বিশ্লেষণ থেকে তিনি এগিয়ে যান সর্বহারা শ্রেণীকে জাতীয় মুক্তির জন্য লড়তে নেতৃত্ব দিতে। তার উপলব্ধি ছিল যে সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্ত সকল দেশই সারবস্তুতে উপনিবেশ এবং আধা উপনিবেশের উপনিবেশ থাকতে পারে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবে তার এই ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক বাংলার সাম্প্রদায়িক শ্রেণী দ্বন্দ্বের ওপর তাঁর একটা ভাল উপলব্ধি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ পরিস্থিতি এবং সমকালীন বিশ্ব এই ধারণাকেও সঠিক প্রমাণ করে।তবে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে মাওয়ের একটি তত্ত্ব যা দেখিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের এই যুগে বুর্জোয়ারা আর গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে সক্ষম নয়। একাজটি সর্বহারা শ্রেণীর দায়িত্ব হিসেবে ইতিহাস কর্তৃক অর্পিত হয়েছে। কিন্তু সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে এই গণতান্ত্রিক বিপ্লব আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের অংশ এবং এর লক্ষ্য সমাজতন্ত্র। এই বিপ্লব অব্যাহতভাবে সমাজতন্ত্র অভিমুখে এগিয়ে যাবে।
কমরেড মাও এক নতুন ধরণের পার্টির ধারণা বিকশিত করেন যা বিপরীতের ঐক্যভিত্তিক অর্থাৎ দুই লাইনের সংগ্রাম ভিত্তিক পার্টি গড়ে তোলা যা গনযুদ্ধ সুচনা ও বিকাশে সক্ষম, নিপীড়িত সকল শ্রেণীসমূহকে ঐক্যবদ্ধ ও নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
মাও এক নতুন ধরণের বাহিনীর ধারণা বিকশিত করেন যা জনগনের কাছে বোঝা হবেনা বরং উৎপাদনের সাথে যুক্ত থাকবে। তেমনি ভাবে হার্মাদ বাহিনী বা মাওদের স্কট বাহিনী তৈরি করে, এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মাওবাদীরা।ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার থাকার ফলে ,অনেক মা ও রাজনৈতিক নেতারা ভারতবর্ষের শাসক দলের সাথে ভিড়ে রয়েছে তেমনি খবর গোয়েন্দা সূত্রে। মাও রাজনীতির ইতিহাস কি বলছে। এই কথাগুলো যদি না লিখি তাহলে আজ এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিতে, চেয়ারম্যান মাও ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করেন এবং “উৎপাদিকা শক্তি” সংক্রাšত সংশোধনবাদী থিসিসের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সংগ্রামকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে সিদ্ধাšত টানেন যে উপরিকাঠামো তথা চেতনা ভিত্তিকে রুপাšতর করতে পারে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তিকে বিকশিত করা যায়। রাজনীতি হচেছ অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ, লেনিনবাদী এই ধারণাকে বিকশিত করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যে, রাজনীতিকে অবশ্যই কমান্ডে থাকতে হবে (সর্ব¯তরে প্রযোজ্য) এবং রাজনৈতিক কাজ হচেছ অর্থনৈতিক কাজের প্রাণসূত্র যা স্রেফ এক অর্থনৈতিক পলিসি নয় বরং আমদের রাজনৈতিক অর্থনীতির সত্যিকার সমাধানে নিয়ে যায়। অন্যদিকে মাও দেখিয়েছেন যে আমলাতান্ত্রিক নির্দেশ দ্বারা নয় বরং জনগণের উদ্যোগ বাড়ানোর মাধ্যমেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে নির্মাণ করা যায়। মাও ‘বুর্জোয়া অধিকার’-এর ভাবাদর্শের ওপর অব্যাহত আঘাত হানার আহ্বাণ জানান।মাও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বহু নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করেন যথা, ভারী শিল্পকে কেন্দ্রে রেখে হালকা শিল্প ও কৃষির যুগপৎ বিকাশ, রাজনীতি কমাণ্ডে, লাল ও দক্ষ, বৃহৎ ও গণ, আংশিক গুণগত রূপান্তর, ভারসাম্য ও ভারসাম্যহীনতা, নিবিড় কর্মসূচী, গণমালিকানার রূপান্তর, দুই পায়ে হাটা তথা আত্মনির্ভরশীলতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিনির্মাণ, যৌথস্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া, উৎপাদনের যৌথ পরিচালনা, দুই অংশগ্রহণ(শ্রমিকদের ব্যবস্থাপণায় অংশগ্রহণ, ব্যবস্থাপণার উৎপাদনশীল শ্রমে অংশগ্রহণ), মহান অগ্রগামী উলম্ফণঃ “অধিক! দ্রুততর! অধিকতর ভাল!অধিকতর মিতব্যয়ীভাবে!”, প্রাচীন নিয়মকানুন ও কুসংস্কারের বিলোপ, বুর্জোয়া অধিকারের ভাবাদর্শের ধ্বংস, পরিকল্পনা প্রণয়ন, ইত্যাদি বহুকিছু।আজও আমলাতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাস করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা। তবে তৎকালীন যুগে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের প্রবক্তা মাও তাঁর কমরেডদেরসহ চীনে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে প্রবল সংগ্রামের মুখে পড়েই উপলব্ধি করলেন যে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণকে একটি পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শিক রাজনৈতিক লাইন হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমরেড স্তালিনের আমল থেকেই যে বিচ্যুতিতে গড়িয়ে পড়ে তা চীনেও প্রতিফলিত হয়। সমাজতন্ত্রের প্রকৃতি সম্বন্ধেই ঐসব ভ্রান্তি সংশোধনবাদের জন্য জায়গা করে দিয়েছিল। উৎপাদিকা শক্তির তত্ত্বের প্রাথমিক যে প্রবণতা স্তালিনের রচনায় খুঁজে পান তাকে মাও একে একজন কমিউনিস্টের ভুল হিসেবেই দেখেছেন।
সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণকে মাও প্রবল গণ আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন। মাও ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। উৎপাদন সম্পর্ক ও উপরিকাঠামোর অব্যাহত বিপ্লবীকরণের কথা বলেন। মহান অগ্রগামী উলম্ফণ রূপে জনগণের সাহসী প্রবল অতিকায় প্রচেষ্টাকে এভাবে দেখতে হবে। স্তালিন ও সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ ভুলবশতঃ মনে করেছিলেন যে সমাজতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা আর উৎপাদিকা শক্তির কিছুটা বিকাশ। মাও লক্ষ্য করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নে উৎপাদন সম্পর্কের অগ্রগতি মৌলিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। মাও শিক্ষা দেন যে উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে মালিকানা ব্যবস্থাই নির্ধারক, তবে সমাজতন্ত্রের অধীনে গণমালিকানাকে সারবস্তু ও রূপ উভয়তই সমাজতান্ত্রিক হতে হবে। সমাজতান্ত্রিক মালিকানা ব্যবস্থার সাথে উৎপাদন সম্পর্কের অন্য দুটো দিকের যথা উৎপাদনে নিযুক্ত মানুষে মানুষে সম্পর্ক, ও বন্টন ব্যবস্থার আন্তঃক্রিয়ার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। এদিকে প্রায়ই একটি ব্যাপারকে তার গুরুত্ব সত্ত্বেও পাশে ফেলে রাখা হয়, বিশেষত তাদের কর্তৃক যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করছেন, সেটা হচেছ আমলাতান্ত্রিক পুঁঁজিবাদ সংক্রাšত মাওবাদী থিসিস অর্থাৎ সেই পুঁজিবাদ যা নিপীড়িত দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন মাত্রার সামšতবাদের ভিত্তিতে অথবা এমনকি প্রাক-সামšতবাদী ¯তরসমূহের ভিত্তিতে গড়ে তুলছে। এটা হচেছ একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, প্রধানত, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়। একজন ভালো রাজনৈতিক নেতৃৃত্ব এ সংক্রাšত উপলদ্ধি থেকে উদ্ভূত হয়, যেখানে আমলাতান্ত্রিক পুঁজির বাজেয়াপ্তকরণ দ্বিতীয় ¯তর হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার অর্থনৈতিক ভিত্তি গঠন করে।তবেই বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সমাজতন্ত্রে, চেয়ারম্যান মাও সামাজিক শ্রেণীসমূহের তত্ত্বকে আরো বিকশিত করেন তাদেরকে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে। তিনি বিপ্লবী সহিংসতাকে ব্যতিক্রমহীন সার্বজনীন নিয়ম হিসেবে তুলে ধরেন, এক শ্রেণীর দ্বারা আরেক শ্রেনীর সহিংস প্রতিস্থাপন হিসেবে বিপ্লব, এভাবে এই মহান থিসিস প্রতিষ্ঠা করেন যে ‘‘বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়িয়ে আসে’’। তিনি নিপীড়িত দেশগুলোতে গ্রামাঞ্চল দিয়ে শহারাঞ্চল ঘেরাওয়ের পথের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন সমাধান করেন তার সাধারণ নিয়মসমূহ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। তিনি সমাজতন্ত্রে শ্রেণীসংগ্রাম সংক্রাšত তত্ত্ব সূত্রায়িত ও বিকশিত করেন, যাতে তিনি প্রতিভাদীপ্তভাবে উল্লেখ করেন যে সর্বহারা শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে, সমাজতাšিত্রক পথ ও পুঁজিবাদী পথের মধ্যে এবং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে বৈর সংগ্রাম চলে। সমাজতন্ত্রে এটা মূর্তভাবে নির্ধারিত হয়নি কে কাকে পরাজিত করবে, এটা হল একটা সমস্যা যার সমাধান সময় দাবী করে, পুনপ্রতিষ্ঠা ও পাল্টা পুনপ্রতিষ্ঠার এক প্রক্রিয়ার শুরু, সর্বহারা শ্রেণীর জন্য শক্তিশালীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল রাখা–অবশ্যই সর্বহারা একনায়কত্বের মাধ্যমে এবং চুড়াšতভাবে ও প্রধানত ঐতিহাসিক কালজয়ী চমৎকার সমাধান আর তা হচেছ সর্বহারা একনায়কত্বধীন বিপ্লবকে অব্যাহত রাখতে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব। অন্যদিকে
১৯৮৪ সালে রিম গঠিত হয়েছিল চতুর্থ আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ’৯২ সালে আন্তর্জাতিক যৌথ উপলব্ধি রূপে মাওবাদের গ্রহণ ছিলো বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টদের এক বিরাট বিজয়। মার্কস ও এঙ্গেলস থেকে আমরা পেয়েছি মার্কসবাদ। লেনিন ও স্তালিন থেকে লেনিনবাদ। মাও, সিরাজ সিকদার, চারু মজুমদার, গনসালো প্রমুখ থকে আমরা পাই মাওবাদ। এসব হচ্ছে গাছের গোড়া। এথেকে ডালপালা আসে মালেমার রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শন।তবে মাওবাদের একটি তত্ত্ব হচ্ছে আংশিক গুণগত রূপান্তরের তত্ত্ব। তাই ভাববাদীরা যেমনটা মনে করে তেমন হঠাৎ করেই নবম কংগ্রেসে মাও চিন্তাধারা বিশ্বজনীনভাবে আবির্ভূত হয়নি। এ কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। মাও ১৯৩৬ সালে দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে ও অনুশীলন প্রসঙ্গে লেখেন, দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ, আধা-সামন্তাবদী আধা ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ, নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতন্ত্রের পথে মহান অগ্রগামী উলম্ফণ, সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব এগুলো একেকটা পর্বে এসেছে। ডিম থেকে পিউপা, পিউপা থেকে মথ, মথ থেকে রেশম পোকা; মানুষের শৈশব থেকে তারুণ্য, তারুণ্য থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রবীণ বয়স, প্রবীণ বয়স থেকে বৃদ্ধ…ইত্যাদি হচ্ছে মাও বর্ণিত আংশিক গুণগত রূপান্তরের উদাহারণ। প্রকৃতির ক্ষেত্রে যা ঘটে, সমাজের ক্ষেত্রে যা ঘটে মানুষের চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ১৯৩৫ সালের মাওচিন্তাধারা আর ১৯৬৯ সালের মাওচিন্তাধারা এক ছিলনা, আর ১৯৬৯ সালের মাওচিন্তাধারা আর আমরা যাকে মাওবাদ বলছি তাও এক নয়, সবই সার্বজনীন কিন্তু পার্থক্য রয়েছে। কমিউনিস্ট ইশতেহারের মার্কসবাদ, পুঁজির মার্কসবাদ, আর প্যারি কমিউন পরবর্তী মার্কসবাদ—সবই সার্বজনীন কিন্তু সমান নয়। তাই বিভিন্ন স্তরের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মাওবাদ , মাও সেতুং এর নীতি আদর্শের কথা। সেই কারণেই মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব হচ্ছে চেয়ারম্যান মাওয়ের সর্বাধিক সীমাতিক্রমকারী বিকাশ। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির অধিবেশনে বলা হয়েছেঃ“উৎখাত হওয়া সত্ত্বেও বুর্জোয়ারা ক্ষমতা পুনর্দখলের লক্ষ্যে শোষক শ্রেণীসমূহের পুরোনো ধারণা, সংস্কৃতি, অভ্যাস ও উপায়ের মাধ্যমে জনগণকে দূষিত করতে আর জনগণের মন জয় করার প্রচেষ্টা চালায়। সর্বহারা শ্রেণীকে করতে হবে ঠিক তার বিপরীত; মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের সকল চ্যালেঞ্জের প্রতি সে নির্দয় মুখোমুখি আঘাত ছুঁড়ে দেবে এবং তার নিজস্ব নতুন ধারণা, সংস্কৃতি, অভ্যাস ও উপায়ের মাধ্যমে সমগ্র সমাজের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটাবে। আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করা কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা পুঁজিবাদী পথ অনুসরণ করছে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া ‘কর্তৃপক্ষসমূহ’ কে সমালোচনা ও অপসারণ করা, বুর্জোয়া ও অন্যান্য শ্রেণীসমূহের মতাদর্শকে সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যান করা, এবং সমাজতন্ত্রের অথনৈতিক ভিত্তির সাথে অসাঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা আর উপরিকাঠামোর অবশিষ্ট ক্ষেত্রসমূহকে রূপান্তর করা যাতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুসংহতকরণ ও বিকাশে সহায়তা করা যায়।” সেই লক্ষ্যে কমরেড সিরাজ সিকদার, কমরেড চারু মজুমদার ও কমরেড গনসালো মতাদর্শের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন, ভ্রান্ত পথের পথিকরা এটা স্বীকার করতে চায়না। তাহলে, তাদের অবদান কি অ-মতাদর্শ? মতাদর্শ কীভাবে উদ্ভূত হয়? সিরাজ সিকদার ও চারু মজুমদার বাংলাদেশ ও ভারতের বিপ্লবের মৌলিক অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারেননি বলতে চাইছে এরা। এদেশের বিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করাটাই, একটি মৌলিক সমস্যার সমাধান। এসব ভ্রান্ত চিন্তানুসারীদের মত অনুসারে মার্কসবাদকে এখন নেতিকরণ করা যাবে। কিন্তু বস্তুবাদের নিয়মনুসারে তা হতে পারেনা। প্রত্যেকটি বস্তু বা ঘটনার রয়েছে জন্ম, বিকাশ ও পরিণতি। বস্তুকে এই সীমার মধ্যে দেখতে হবে। মার্কসবাদের জন্ম হয়েছে কমিউনিস্ট সমাজের আদর্শকে ধারণ করে। কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তা নেতিকৃত হবে না। এই কালপর্বের পরিসমাপ্তির সাথে সাথে মার্কসবাদেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবে তা আরো উন্নত কিছু জন্ম দেবে। অর্থাৎ আরো অগ্রসর কিছূ দ্বারা নেতিকৃত হবে। অপরদিকে সংশোধনবাদ কখনোই মার্কসবাদকে নেতিকরণ করতে পারবে না, কারণ তার সেই শক্তি নেই। ভ্রান্ত পথের পথিকদের মতে, “চিন্তাধারা” কোন দেশীয়/রাষ্ট্রীয় বিষয় হতে পারে না। যেন আন্তর্জাতিকভাবে উদ্ভূত হয়ে চিন্তাধারাকে কোন দেশে হাজির হতে হবে। মানুষকে যেমন কোন না কোন দেশে বাস করতে হচ্ছে, চিন্তাধারাকেও কোন না কোন দেশে জন্ম নিতে হচ্ছে, তারপর সেটা আন্তর্জাতিক চরিত্র পরিগ্রহ করে।