মতামত

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।

মৃত্যুঞ্জয় সরদার: আদর্শ আর সততা মানুষকে ত্যাগী করে তোলে,ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করে আবার বলতে চাই সত্যের জন্য মৃত্যুবরণ করেছে বহু ঋষি মনি ও মনীষীরা।আদর্শ কোনোদিন কারোর কাছে নত হতে দেয়না। আদর্শই মানুষ জীবনে, এগিয়ে চলার পথ দেখায়।চিরাচরিত ইতিহাসে যত দেখছি, আদর্শ কোনদিন কোথাও বিক্রি হতে চাইনা। এমনই মনীষীরা জন্মেছে এই ভারতবর্ষে এই বাংলার বুকে।এ কথা লিখতে বসে আমার জীবনের কিছু মুহূর্তের স্মৃতি বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে।সে কথাগুলো এই লেখার মধ্যে যদি না বলে যায়, তাহলে সমাজের অনেক এই ইতিহাস আজও অজানা থেকে যাবে। ছোটবেলা থেকেই আমি সহ আমার সপরিবারে সবাই রাজনীতিতে স্বীকার।রাজনীতিক অকথ্য অত্যাচার অবিচার সহ্য করতে হয়েছিল আমার গুরুজনদের ,সেই অত্যাচার আজও আমার পরিবারের সহ্য করতে হচ্ছে। আদর্শকে সামনে রেখে আমার গুরুজনেদের পথ পথ চলাটা সমাজের মানুষের কাছে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।আমার গুরুজন দুখিরাম সদ্দার কোন কিছুর বিনিময় আদর্শকে  কালিমা লিপ্ত হতে দেয়নি।তার জীবনে বহু অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, অত্যাচার সহ্য করতে করতে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। তিনি টাকার বিনিময় আদর্শকে বিক্রি করে দেয় নি, নিজের স্বার্থের জন্য রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও করিনি। এ কথাগুলি লেখার ইচ্ছা না থাকলেও লিখতে বাধ্য হলাম, সেই কথাগুলো একটু বলি।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিল, তেমনই দুখিরাম সরদার কমিউনিস্ট আদর্শে আদর্শিত হয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত বলি দিলেন। জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে নিজের আদর্শকে বুকে চাপিয়ে পাহাড় বানিয়ে, নোনা হওয়া, নোনা জলের নোনা মাটির, সঙ্গে মিশে পড়েছিল অধম দুখিরাম।তার মূল্য যেমন এযুগের কমিউনিস্টরা দিতে পারেনি। তেমনি ভাবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবি অনাহারে ও অনাচারে মারা গেল তার মূল্য দেননি কমিউনিস্টরা।আদর্শবান কমিউনিস্ট কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের, ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের, তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্য আদর্শকে কালিমালিপ্ত করেছিল মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন। আর সেই ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়— যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানব সভ্যতার আশীর্বাদ-অভিশাপ।একদিন আমাদের সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে কিন্তু ইতিহাস থেকে যাবে। আর সেই জন্য বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুকান্তকে আমি ভালবেসেছিলুম, যেমন করে প্রৌঢ় কবি তরুণ কবিকে ভালবাসে।’ বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের ছন্দজ্ঞানেরও প্রশংসা করেছেন। এইখানে একটু প্রসঙ্গান্তর হয়ে বলব, বর্তমানকালে ওই ছন্দ জিনিসটির প্রশংসা আর সহজে আসে না। আমরা এখন কবিতাকে টেনে-টেনে নিয়ে যাচ্ছি। যা হোক, মনে-মনে তিনি সুকান্তকে মার্কা দিয়েছিলেন জাত-কবিদের ক্লাসে। উঁচু পর্দায় আশাও দেখেছিলেন। কিন্তু এরপরই বলছেন, ‘কিন্তু আশা তো বিশ্বাসঘাতিকা!’ সুকান্তের রাজনৈতিক কাব্য-বিশ্বাস বুদ্ধদেব বাবুকে খুশি করতে পারেনি, বরং ছেলেটি তাঁর কবিতার মতামত চেয়ে অগ্রজ বুদ্ধদেব বসুর কাছে যখন একটি পোস্টকার্ড পাঠালেন, তিনি উত্তরে লিখলেন, ‘রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয় করছ তুমি; তোমার জন্য দুঃখ হয়।’ আমরা জানি না, এই নির্মম বাক্যটি সুকান্ত কীভাবে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর বিশ্বাসকে টলাতে এ কথা পারেনি। কবি হওয়ার চাইতে কমিউনিস্ট হওয়ার বাসনা হয়তো অতিরিক্ত রোমান্টিকতার প্রকাশ হতে পারে, কিন্তু তা চিন্তাগতভাবে সুকান্তের রিক্ততার প্রকাশ নয়। এই বুঝটুকু ইউরোপের আধুনিকদের ছিল, কিন্তু ভারতবর্ষের‘আধুনিকতাবাদীদের’ হলো না। এমন আরও উদাহরণ বুদ্ধদেব বসু থেকে দেওয়া যেতে পারে। এই ইতিহাস নির্ধারণ করে দেয় আমাদের জীবনাচরণ কেমন হবে। তবে এই লড়াই খুব সরল নয়। অসরল, অমসৃণ এই রাজনৈতিকতার ভেতর আমাদের বাস্তবতা তৈরি হয়। আমাদের দৈনন্দিনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই রাজনীতি। তাই জাতির স্মৃতিবোধ অথবা বিস্মৃতিবোধ একটি রাজনৈতিক ঘটনা। কখনো তা ঘটে ছাতার রং উঠে যাওয়ার মতো অতি ধীর গতিতে, কখনো আবার তাকে ঘটানো হয় বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। বিশেষ বিশেষ শ্রেণি তার নিজের প্রয়োজনেই স্মৃতিকাতর হয় কিংবা বিস্মরণপ্রবণ হয়ে থাকে।
আজকের যে বাংলাদেশ, এখন সেখানে ‘এখন’-এর রাজত্বই প্রকট। পুঁজি-ব্যবস্থাই যেহেতু আজকের বিশ্বব্যবস্থা, তাই সেই অনুযায়ী আজকের সমাজকে বাজারকেন্দ্রিক হতে বাধ্য করা হয়েছে। সহজ কথায়, বাজার যদি কেন্দ্র হয়, তবে তার মূল কাজটি হলো মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদিত পণ্যকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। ‘সকলি ভোগের তরে’—এই কথাটি নানা স্বরে, সুরে প্রচার করা। ভোগ আছে তো মজা আছে। মজা বিনা জীবন নাই। বুর্জোয়া সমাজে তখন মজা মারার নানান সাংস্কৃতিক অছিলা তৈরি হয়। শিল্প-সাহিত্য তা থেকে দূরে থাকতে পারে না। যে সাহিত্য তা থেকে জীবনকে দূরে রেখে মানুষের সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বলতর করার প্রয়াস পায়, তাকেই আমরা ‘প্রতিরোধের সাহিত্য’ বলি।এমনই সাহিত্যতত্ত্ব বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় থেকে পড়ার পর আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি নিজের জীবনে। তাই আমার কলমে পুনরায় তুলে ধরতে চাই বিদ্রহ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য জীবন কাহিনী।সুকান্ত ভট্টাচার্য কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কৈশোর থেকেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে।১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা প্রতিভা সুকান্ত ভট্টাচার্য অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গ কলকাতার ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটে তাঁর নানার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার(বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। জেঠতুতো দিদি রাণীদি নাম রাখেন সুকান্ত, ‘রমলা’ খ্যাত সাহিত্যিক মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প ‘সুকান্ত’-এর নামে। তবেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কোলকাতার কমলা বিদ্যামন্দির থেকে | এখানেই তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় স্কুলেরই নিজেস্ব পত্রিকা “সঞ্চয়ে” | সেই স্কুলে তিনি বেশ কিছুবছর পড়াশোনা করেন, এবং তারপর তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে | এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি সেই পরীক্ষায় ফেল করেন |আর যাই হোক
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন | এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে । ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন,  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষনভাবে সোচ্চার হন |সেই কারনে সাম্যবাদে বিশ্বাসে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪২ সালে যোগ দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৪ সালে সুকান্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ এর আগে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে যান। ফলে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। সুকান্তের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অবসান হয় সেখানেই। এতে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ক্ষান্ত হননি, থেমে থাকেনি তার জীবনধারা। বরাবরই অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই রচনাবলী প্রকাশের কয়েকটা বছর আগেই, সুকান্ত কে আমরা যেভাবে জানতাম।১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা রেডিওর গল্পদাদুর আসরের যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর তাঁর সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন অন্যতম গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। তবে সুকান্ত কে নিয়ে বহু লেখক তার বিভিন্ন জীবনধারার কথা তুলে ধরে ছিল তার মধ্যে অন্যতম একজন লেখক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা থেকে আমার অনুভূতি হয়েছিল। এই লেখার মধ্যে তেমনই কিছু তথ্য ফুটিয়ে তুলছে আমার কলমে।ঢাকার অলিঁয়স ফ্রাঁসেজে র‌্যাঁবোর কবিতা নামের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সুকান্ত ভট্টাচার্যের নামটি আলোচনায় উঠে আসে। আলোচনায় অংশ নিয়ে আমিই প্রথমে বলতে চাইলাম যে প্যারি কমিউন ধরনের ঘটনার তাৎপর্য নিয়ে লেখা আর্তুর র‌্যাঁবোর কবিতাতে দ্রোহ এবং প্রতিবাদের উপদানকে লক্ষ্য না-করাটা দুঃখজনক। অনেকেই বলতে চাইলেন সুকান্ত, কিট্স্ এবং র্যাঁবোর মধ্যে রয়েছে মেরু-দূরত্ব। একজন বললেন যে সুকান্ত সুররিয়ালিস্ট-সিম্বোলিস্ট র‌্যাঁবোর উচ্চতার কাছাকাছিও যান না। এই অদ্ভুত প্রবণতাটি সম্পূর্ণ নতুন নয়। সরাসরি এবং প্রত্যক্ষ অর্থপূর্ণতার সকল কবিতাকে শ্লোগান ঘোষণা করে বাতিল করার এই মনোভঙ্গীটি স্বাধীন বাংলাদেশেও ক্রমশ জোরদার হয়েছে। সামরিক শাসন এবং অন্য রাজনৈতিক অধোগমনের পাশাপাশি কবিতা ক্রমশই তার জনলগ্নতা এবং স্পষ্টার্থকতাকে হারিয়েছে। আবারও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এতে মদদ এসেছে ‘পোস্ট’ ইজমগুলোর দিক থেকে। এখানে ভাবাখানা হচ্ছে আদর্শ কবিতা হবে শব্দের অর্থহীন সমাবেশ; কবিতা যতো স্বল্পার্থক হবে কিংবা শুধুই শৈলীর ব্যয়াম, ততোই তা আদর্শস্থানীয়। কিংবা ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন নিমগ্নতা যতো শতভাগ পরিবেশিত হবে ততোই তা আদর্শ শিল্প কিংবা সাহিত্য। র‌্যাঁবোরা যে সুররিয়ালিস্ট-সিম্বোলিস্ট হয়েও সমাজলগ্ন থাকতে পেরেছিলেন, অস্তিত্ববাদী হয়েও যা সম্ভব হয়েছে জাঁ পল সার্ত্র কিংবা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর পক্ষে, তা অনেকে মনে রাখেন না। সমাজব্যবস্থা নামক কারাগারে যে অস্তিস্ত¡¡বাদী দুর্দশা তৈরী হতেই পারে, তার হতাশা-নৈঃসঙ্গও, এ সত্যকে কি যান্ত্রিক আশাবাদের অস্ত্রের সাহায্যে অস্বীকার করতেই হবে? এই বিতর্কের জন্যে প্রাসঙ্গিক কিছু উপাদান পাওয়া যায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি ভিন্ন ধরনের চিঠিতে; বন্ধু অরুণাচল বসুর মা সরলা বসুকে লেখা একটি চিঠির একাংশ নি¤œরূপ:সুকান্ত ভট্টাচার্য মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিল তার জীবনের অনাহারে মরার আকৃতি।
বাস্তবিক, আমি কোথাও চলে যেতে চাই, নিরুদ্দেশ হয়ে মিলিয়ে যেতে চাই …কোনো গহন অরণ্যে কিংবা অন্য যে কোনো নিভৃততম প্রদেশে; যেখানে মানুষ নেই, কেবল সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট-মনা হিঃস্র আর নিরীহ জীবেরা, আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এতোরও দরকার নেই, নিদেনপক্ষে আপনাদের ওখানে যেতে পারলেও গভীর আনন্দ পেতাম, নিষ্কৃৃৃতির বন্য আনন্দ, সমস্ত জগতের সঙ্গে আমার নিবিড় অসহযোগ চলছে। এই পার্থিব কৌটিল্য আমার মনে এমন বিস্বাদনা এনে দিয়েছে, যাতে আর আমার প্রলোভন নেই জীবনের ওপর। … এক অননুভূত অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করেছে। সমস্ত পৃথিবীর ওপর রুক্ষতায় ভরা বৈরাগ্য এসেছে বটে। কিন্তু ধর্মভাব জাগেনি। আমার রচনাশক্তি পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেছে মনের এই শোচনীয় দুরবস্থায়। প্রত্যেককে ক্ষমা করে যাওয়া ছাড়া আজ আর আমার অন্য উপায় নেই। আচ্ছা, এই মনোভাব কি সবার মধ্যেই আসে এক বিশিষ্ট সময়ে?
এখানে একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ পাচ্ছি, এক বিশিষ্ট বামপন্থীর জীবন থেকে, প্রত্যাহার ও হতাশার মনোভাবের। আধুনিক ইউরোপের অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীর জীবনেও ব্যর্থতা-অসহায়ত্বের পরিস্থিতিতে এসেছে নৈরাজ্যবাদী-উচ্ছৃঙ্খল-ভাববাদী আচরণ, কর্মকা-, লেখালেখি। সেখানে ডাডাইজম, সুররিয়ালিজমের মতো সাড়া-জবাবকে দেখামাত্রই ক্ষয়িষ্ণু-নেতিবাচক বলে দেয়ার সুযোগ কতোটা? মার্ক্স ধর্মকে পর্যন্ত বলেছিলেন “হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়”, “নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘঃশ্বাস” এবং শেষ পর্যন্ত “জনগণের আফিম”। এরূপ প্রতিটি অভিধাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, গভীরভাবে বিবেচ্য। সুকান্ত অবশ্য ধর্মে পৌঁছে যাননি, কিন্তু তিনি তা উল্লেখ করায় বোঝা যায়, তার সম্ভাবনাটা তিনি বাতিল করেন নি। হৃদয়হীন পৃথিবীকে সহৃদয় ক’রে গড়ে তোলার আয়োজনে যান্ত্রিক মনোভাবের ক্ষতি বৃহৎ। সামগ্রিকতায় দেখারও কোনো বিকল্প নেই। রেনেসাঁস এবং সংশ্লিষ্ট সব হচ্ছে মূল্যবানকে ফিরিয়ে আনার আয়োজন, সমগ্রকে ফিরে পাওয়া। সুকান্তকে ফিরে পাওয়ার এই আয়োজনে লক্ষ্য করে আমাদের এই বিস্ময় যে “অলক্ষ্যে” কবিতায় তিনি নি¤œরূপ লিখেছিলেন। অন্যদিকে সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পুরন করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ীতে। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন।   পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৩ মে, ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন । গ্রণ্থ তালিকা ছাড়পত্র (১৩৫৪ ব.) ঘুম নেই (১৩৫৭ ব.) পূর্বাভাস (১৩৫৭ ব.) অভিযান মিঠে-কড়া (১৯৫১) হরতাল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ই আগস্ট, ১৯২৬ – ১৩ই মে, ১৯৪৭)  

Related Articles

Back to top button