সুন্দরবনের ইতিহাস বহন করে চলেছে জটার দেউল’ দেবালয়টি
মৃত্যুঞ্জয় সরদার
অনন্ত কাল ধরে সত্যকে বিলুপ্ত করতে একের পর এক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে ভ্রষ্টাচারি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ।সামাজিক বৈষম্য টা একশ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ তৎকালীন যুগে প্রচলন করেছিল। নিজের স্বার্থের ভোগ বিলাসিতার সুবিধার্থে জন্য । বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় তেমনই সুবিধাবাদ একশ্রেণীর মাতব্বররা আজো বিরাজমান। সত্যকে ধামাচাপা দিতে, মরিয়া হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।চিরাচরিত এসব ব্যক্তিরা একটু ভোগ বিলাসিতা আর ধনী হতে চায়! রাজশাসন এর পণ্য ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পাশ্চাত্য পটভূমি তৈরি করেছিল,তার নিদর্শন সুন্দরবনের জঙ্গলের তলদেশে মাটির তলায় লুকিয়ে রয়েছে। মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার যুগে, সুন্দরবনের জনবসতি ছিল। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী তীরে দেবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।আজ আমরা যে সুন্দরবনের জল জঙ্গল আর জমিন দেখছি সেই সুন্দরবনের মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার সময়ে মানুষের বসবাস ছিল। তার নিদর্শন সুন্দরবনের জঙ্গলের নমুনা কিছুটা পাওয়া গেছে,আজ আমরা কোন ভাইরাসের মহামারী দেখছি মানব সম্পদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রাচীনকালের উপকূলবর্তী নগরী গুলোকে ধ্বংস করে, নদী মাতৃক শহর-বন্দর পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। তার নিদর্শন ২৪ পরগনায় আজও প্রমাণিত। ২৪ পরগনা কে ভেঙে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা করা হয়েছে,এই জেলার ভৌগলিক অবস্থান ছিল কলকাতার যাদবপুর, টালিগঞ্জ ও বাঘাযতীন, পিয়ালী নদীর উপকূলবর্তী জনবসতি এই পর্যন্ত সুন্দরবন অবস্থিত।১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে ভারতে প্রথম ভাইসরয়। বিখ্যাত রাজনীতিজ্ঞ জর্জ ক্যানিংয়ের তৃতীয় পুত্র চার্লস জন ক্যানিং। তাঁর প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের শুরু। লর্ড ক্যানিং এই বিদ্রোহটি দমন করেন এবং এ ঘটনার পর ১৮৫৮ সালে পার্লামেন্টারি আইন পাশ হয়। ক্যানিং যতদূর সম্ভব ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বাছবিচারহীন প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ পরিহার করেন এবং ‘ক্ষমাশীল ক্যানিং’-এর উপাধি অর্জন করেন। লর্ড ক্যানিং-এর প্রশাসনের শেষদিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাশ, যার দ্বারা বেসরকারি ভারতীয় সদস্যগণ ভাইসরয়ের আইনসভায় মনোনীত হতে পারতেন। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের সময়কার গুরুভার ও কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ক্যানিং অবসর গ্রহণ করে ১৮৬২ সালে ভগ্নস্বাস্থ্যে ভারত ত্যাগ করে চলে যান ইংল্যান্ডে। সেই থেকেই রয়েছে ক্যানিংসের ‘হাউস’, যা আজ প্রায় ধ্বংসাবশেষ।জরাজীর্ণ ভগ্নদশা বাড়ি কি আজও রয়েছে স্মৃতি হয়ে ক্যানিংয়ের বুকে। ব্রিটিশ আমলের ক্যানিং আজ পঞ্চায়েত পৌরসভা থেকে, মাতলা নদী তীরে গড়ে ওঠা শহরটিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজে লাগানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।এবং সুন্দরবনের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টাও করেছিলেন, ব্রিটিশদের সব স্বপ্ন আজ বিফলে। রাজনীতির ইতিহাস সে কথা প্রমাণিত,তবে বৃষ্টির মতন দীর্ঘ বছর রাজত্ব ভারতবর্ষের কোন শাসক দল করতে পারিনি। সেই সময় ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দিতে মাতলা নদীর তীরে ‘আধুনিক বন্দর’ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ‘লাটসাহেবের’ নির্দেশে সেই কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। জঙ্গল কেটে তৈরি হল নয়া কোম্পানির সদর দফতর, জনপদ।কোম্পানির সদরদপ্তর তৈরি হওয়ার বহুকাল আগে মাতলা নদীর তলদেশের তলিয়ে গিয়েছে আর এক নগর সভ্যতার জনপদ। অন্যদিকেই শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা লোকাল ট্রেন এ প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মথুরাপুর স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেকার বা বাস বা অটো করে ঘন্টা খানেকের মধ্যে রায়দীঘি পৌঁছে যান। এরপর মুড়ি বা মনি নদীর উপর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে মোটর ভ্যান বা লাদেন গাড়ি, এতে করেই গ্রাম্য পথে আধা ঘন্টার মধ্যেই জটার পূর্ব গ্রাম ও পশ্চিম গ্রাম এর মাঝেই পিচকালো রাস্তার ধারেই জটার দেউল আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই রাইদিঘী হল সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশপথ। মুড়ি বা মনি নদী বেয়েই চলে যাওয়া যায় সুন্দরবনের গভীরে। এই পুরো পথেই গ্রাম্য সতেজতা আর বিভিন্ন পাখিরা আপনাকে সঙ্গ দেবে। আর আছে কিছু গ্রাম্য সরল মানুষ, যারা আপনাকে প্রতি নিয়ত সাহায্য করবে জটার দেউল এ পৌঁছাতে।সেই সাহায্যপ্রার্থী মানুষের নাম না লিখলে আজ হয়তো ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।ছোটবেলায় বড় হয়ে ছিল মনি নদীর তীরে ঘুরে বেরিয়ে ,গুরুজনদের সাথে মাছ ধরতে আসতেন ছোটবেলার সেই স্বপন সরদার। বর্তমান আদিবাসী সমাজের বিশিষ্ট পুরুষ ,আদিবাসী সমাজ সংস্কারক ও ভাষা আন্দোলনের হাতিয়ার তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে । অল আদিবাসী সদরী সুসর অ্যাসোসিয়েশন জন্মদাতা।আদিবাসী সমাজের এই মহান ব্যক্তির সান্নিধ্যে আমি এসেছিলাম, আর তার মুখ থেকে উপলব্ধ করেছিলাম সুন্দরবনের প্রাপ্ত ইতিহাসের কথা।
চারদিকে ফাঁকা মাঠ আর ধানক্ষেত, আর তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই পোড়া ইঁটের মন্দির। এই চারদিকের মাঠে বিশেষ বিশেষ সময়ে ঘোড়াদৌড়, মেলা ইত্যাদি হয়ে থাকে। একদম গ্রাম্য এলাকাতে অবস্থিত হবার জন্য, জায়গাটি এখনো পরিষ্কার রয়েছে। মন্দিরের চারদিকে রয়েছে পরিচ্ছন্ন মাঠ, আর তার থেকেই কিছুটা ঘিরে নিয়ে পাঁচিল দিয়ে একটা বাগান মতো করা হচ্ছে, আর মধ্যে কয়েকটি স্টিলের সোফা বসানো হয়েছে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে এই দেবদেউলটি সত্যি একটা মন ভালো করে দেবার মতো আবহ তৈরী করে। সত্যি তারিফ করতে হয় সেই সময়ের শিল্পীদের, যারা এই অপূর্ব শিল্পকর্মের সৃষ্টি করে গেছেন। কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম, সত্যিই যেন দেবাদিদেব মহাদেব তার বিশাল জটা মাথায় নিয়ে ধ্যানে মগ্ন।তবেই জটার দেউল’ সুন্দরবনের বিভিন্ন সাংবাদিকরা তার পাঠ্যপুস্তক এর বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, আসল সত্যটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।এই সত্যটা কে খুঁজে বের করতে গিয়ে বিতরকের চাঞ্চল্য তথ্য উঠে এসেছে আমার অনুসন্ধান বা গবেষণাতে।১৮৬০-এর দশকে মথুরাপুর থানার মধ্যে, লট নং ১১৬, পুরানো আদিগঙ্গার খাত থেকে এখানকার গভীর জঙ্গল পরিষ্কারের সময় ‘জটার দেউল’ নামে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। অনেকের মতে, এখানে জটাধারী নামে এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল; আবার কারোর মতে, জটাধারী বড় বড় বাঘ এখানে ঘুরে বেড়াত। অধিকাংশ প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, জটার দেউলের স্থাপত্যশৈলীর সাথে ভুবনেশ্বরের দেউল স্থাপত্যের মিল আছে এবং সেদিক থেকে ও অন্যান্য আবিষ্কৃত নিদর্শন বিচার করে এর নির্মাণকাল আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দী।তবে ১৯১০-১৫ সালে জঙ্গল সাফ করার সময় জটার দেউলের ছ’মাইল দূরে দেউলবাড়ি নামক স্থানে (লট নং ১২২) এই ধরনের আরও একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় (এখন বিলুপ্ত)। এই স্থানের আধমাইল পূর্বে কমবেশি একবিঘা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছিল। ১৯২১-২২ সালে জটার দেউলের বারো-তেরো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে জগদ্দল গাঙের কাছে আরও একটি মন্দিরের অবশেষের হদিশ মিলেছিল। মাটি খোঁড়ার সময় এখানে (বনশ্যামনগর) ইটের ঘর, প্রচুর ইট মৃৎপাত্রের টুকরো এবং মানুষের অস্থি-কঙ্কাল ইত্যাদি পাওয়া যায়।সুন্দরবনের এসব ইতিহাস লিখলে রামায়ণ ও মহাভারত থেকে অনেক বড় পুস্তকে পরিণত হয়ে যাবে।। তবেই জটার দেউলের
এর আটমাইল উত্তর-পশ্চিমে (লট নং ১১৪) এসময় জঙ্গলের মধ্যে বেশ একটি বড় ইটের স্তুপ খুঁড়ে নিচে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, গর্ভগৃহ ছাড়া এই মন্দিরের আর কোন অংশের চিহ্ন ছিল না। খননকালে চারটি বিষ্ণুমূর্তি (একটি ৪ ফুট উঁচু, দুটি ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং আরেকটি ৩ ফুট ২ ইঞ্চি উঁচু) ও একটি নটরাজমূর্তি (মূর্তিটি ৩ ফুট ১ ইঞ্চি উঁচু, দশহাতযুক্ত; গলায় আজানুলম্বিত একটি মালা আছে, মালার নিচে দশটি নরমুণ্ড ঝোলানো।)। এইসব প্রাচীনকালের নিদর্শনের চিহ্ন বা অস্তিত্ব আজও সুন্দরবনের মাটির তলদেশে মেলে। তেমনই নিদর্শন জটার দেউল।এইবার আসি মন্দিরের নাম নিয়ে। মন্দিরের নাম কেন জটার দেউল তা নিয়ে দু চারটে তত্ত্ব আছে বটে। কিন্তু কোনও তত্ত্বই যে সর্বজন গৃহীত এটা বলা যাবে না। প্রথম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত তত্ত্ব হল জটাধারী ভোলানাথের নামে এই মন্দির। উনি কেবল পৌরাণিক দেবতা নন, জনমানসে তাঁর একটা বিশেষ স্থান আছে। তাই মন্দির তার নামে উৎসর্গীকৃত। আবার কেউ বলেন জটাধারী এক নরখাদক বাঘ এই মন্দিরে থাকত তাই এই মন্দিরের নাম জটার দেউল। কেউ বলেন পাল যুগের শেষে যে সকল বৌদ্ধ আরাধনার স্থল ছিল তার মধ্যে এটি একটি। আবার অনেক ঐতিহাসিক একে আদৌও মন্দির বলতে চান না। তাদের মতে এটি একটি জয়স্তম্ভ যা মহারাজ প্রতাপাদিত্য মুঘলদের বিরুদ্ধে জয়ের স্মারক হিসেবে নির্মিত করেছিলেন। অর্থাৎ এটি সেই অর্থে অনেক নবীন নির্মাণ।বর্তমান মন্দিরটি ভগ্নদশা প্রাপ্ত ও প্রায় ৮০-৮৫ ফুট উঁচু। মন্দিরের চাতাল বর্গাকার এবং প্রস্থে ৩২ ফুট। মন্দিরটি মাটি থেকে প্রায় ১৬ ফুট উঁচু, অর্থাৎ মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি ১৬ ফুট উঁচু এবং ৯ ফুট চওড়া।
কেবল মন্দিরই নয় মন্দিরের আশেপাশে খননের সময় ওই একই ইঁটের তৈরি গৃহস্থ বাড়ি, নানা ধরণের ধাতুর মূর্তি , অলঙ্কার ইত্যাদি পাওয়া গেছে যার থেকে বোঝা যায় যে এই অঞ্চল একদা এক অতি সমৃদ্ধশালী জনপদ ছিল।আর সেই নিদর্শন ইষ্টক নির্মিত এই দেব দেউলটি পঞ্চরথ ভিত্তির উপর এক শিখর বিশিষ্ট। দেউল এর প্রবেশ পথ ক্রমবর্ধমান খিলান যুক্ত। মন্দির এর দেওয়াল টেরাকোটার কাজে অলঙ্কৃত হলেও তার বেশি ভাগই সময়ের জালে অবলুপ্তির পথে। দেউল এর শিখর প্রায় ৬৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য প্রস্থ যুক্ত বর্গাকার এই মন্দির। মন্দিরের সামনের অংশটি দেখলেই বোঝা যায় যে দেউলটি রথের ন্যায়, এই পঞ্চরথ শৈলী বেশি ভাগ দেউল এই অবলুপ্ত। কাজেই জটার দেউল সেই দিক দিয়ে অবশ্যই দর্শনীয়। দেউলটি একটি মাটির ঢিপির উপর অবস্থিত হওয়াতে আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। বিস্তীর্ণ খেতি জমির মাঝে উঁচু মাটির ঢিপির উপর জটার দেউল যেন শিবের উপস্থিতি প্রকট ভাবে জানান দেয়, সঙ্গে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে জটার দেউল আরও আকর্ষণীয়। দেউল এর গর্ভে শিব লিঙ্গ এবং আরও অনেক দেব দেবীর ছবি পূজিত হন। জটার দেউল এ শিব আরাধ্য হলেও যেসব মূর্তি পূজিত হয় তাঁর প্রাগৈতিহাসিক মূল্য না থাকলেও স্থানীয় মানুষের কাছে ভক্তির মূল্য যথেষ্ট, তারই নমুনা মন্দিরের লোহার প্রবেশ পথে অসংখ্য লাল হলুদ সুতোয় ইঁট এর টুকরো বাঁধা যা কিনা মানসিক এর প্রতীক। ASI এর অধীনস্ত হওয়ায় আশারাখি পরবর্তী প্রজন্ম এই মন্দির শৈলী চাক্ষুস করতে পারবে।তবে সুন্দরবনের এই মন্দির ঘুরে রহস্য আরো রহস্যময় হয়ে উঠল, গবেষকরা একমত হতে পারছে না কোন যুগে তৈরি এই মন্দিরটি।এই মন্দিরের নাম ‘জটার দেউল’ কি ভাবে হল বা এই মন্দির আদৌ মন্দির কিনা বা যদি মন্দিরই হয় তাহলে কোন দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। প্রথমে আমরা দেখি কি ভাবে এই মন্দির লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে পুনরায় দিবাকরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হল। ব্রিটিশ শাসন চালু হতেই জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজ (স্থানীয় ভাষায় ‘জঙ্গল হাসিল’ করার কাজ) শুরু হয় এই অঞ্চলে। সেই জঙ্গল পরিষ্কারের সময় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মথুরাপুর ২ ব্লকের অন্তর্গত কঙ্কনদীঘি গ্রাম পঞ্চায়েতে মন্দিরটি পাওয়া যায়। এর গঠনশৈলী উত্তরভারতের ‘নাগররীতি’ অনুযায়ী। খননের সময় মন্দিরে প্রচুর বাঘের কঙ্কাল পাওয়া যায়! আর মন্দির থেকে অদূরেই একটি তামারলিপি পাওয়া যায় এবং ওই তামার লিপি অনুযায়ী জয়ন্তচন্দ্র নামক রাজা ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। তৎকালীন বাংলা সরকার ১৮৯৬ সালে যে ‘List of ancient monument in Bengal’ নামে যে বই প্রকাশ করে তাতে লেখা আছে ‘….The Deputy Collector of Diamond Harbour reported in 1875 that a cooper plate discovered in a place a little to the north of the Jatar Deul fixes the date of erection of the temple by Raja Jayanta Chandra in the year 897 of the bengali saka era corresponding to A.D 975. The cooper plate was discovered at yhe cleaning of jungle by yhe grantee Durgaprosad Chowdhury.The inscription is in sanskrit and the date as usual given in an enigma with the name of the founder’. প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন ওই তামার পাতটি পরবর্তী কালে চুরি যায় এবং এখন তার কোনও খোঁজ নেই।তবে ভীতরে শিবলিঙ্গটি অবশ্য সাম্প্রতিক, সেটা আপনি দেখেই বুঝতে পারবেন। কিছুদিন আগেও একটি প্রদীপ জ্বালানোর কুলুঙ্গি করা ছিল মন্দিরের ভিতরে, যা সংস্কারকার্যের সময় বিলুপ্ত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের তত্ত্বাবধানে স্তম্ভটির অদক্ষ সংস্কারের ফলে এর মূল গঠন ও বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়েছে। স্তম্ভটির সম্পূর্ণ কাঠামোটি সে অঞ্চলের প্রচলিত সরু ইটের তৈরী এবং ফাঁকে ফাঁকে নকশাযুক্ত ইট দ্বারা অলঙ্কৃত। মন্দিরের গায়ে কিছুটা উপর থেকে লাগানো আছে লোহার আংটা, একদম চূড়ো পর্যন্ত। আর চূড়োতে আছে একটি ধাতব ত্রিশূল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই লোহাগুলোতে এখনো জং ধরেনি! অনেকেরই ধারণা মন্দিরপ্রতিষ্ঠা কয়েক শতক পড়ে, এই মিনার পর্তুগীজ-মগ জলদস্যুরা টাওয়ার হিসাবে ব্যবহার করতো বলে অনেকেরই ধারনা। আবার কখনও একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা, কখনও বা হিন্দুমন্দির, এমনকি তীর্থমন্দির, নানাভাবে এটিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে, জঙ্গলে ঢেকে যায় এই মন্দির। অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের মতামত খননকার্য চালানোর সময়, আশে পাশের মাটির তলা থেকে শুঙ্গ-কুষাণ,পর্তুগীজ যুগের মুদ্রা,হাতির দাঁত পাওয়া গিয়েছে।এছাড়াও পাওয়া গেছে ব্রাহ্মণ্য ও জৈন দেবদেবীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি পাথরের বুদ্ধমূর্তি,তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবতা,ব্রোঞ্জের তৈরী মহাকাল,বটুক ভৈরব,জম্ভল,ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর, কুরুকুল্লা, খাদিরবনি তারা, পোড়া মাটির তৈরী তারামূর্তি,বুদ্ধ মারিচি সহ প্রভৃতি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মূর্তি, যা সেই সময়ে নাথ সম্প্রদায়ের লোকজনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে এই অঞ্চলে।এবার এই নাথ সম্প্রদায় সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক। বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় শুরু হয় পালযুগে মধ্যভাগ থেকে। শুধুমাত্র বাংলা ও বিহারেই এই ধর্মের অস্তিত্ব থাকে। বৌদ্ধধর্মের মহাযান মতবাদ থেকে তিব্বতি তন্ত্র ও বাংলার তন্ত্রের প্রভাবে বজ্রযান,কালচক্রযান,শূন্যবাদ সহ নানান তান্ত্রিকঐতিহ্য সৃষ্টি হয়। এই সময়ে, নাথ যোগীরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন, এবং সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে তান্ত্রিক-বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব করেন। আবার কারোর কারোর মতে, সুনির্দিষ্ট ভাবে শুধু যোগী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই লিঙ্গ মূর্তি গুলিকে সংযুক্ত না করে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ঘরানার এগুলি সংযুক্ত করা উচিত। এই সম্প্রদায়গুলোর ধর্মীয় আচারকে বলা হতো গুরুবাদী গুহ্য সাধনাচার সহজযান কিংবা সহজিয়াধর্ম, যার সাংকেতিক ধর্মাচরণ চর্যাপদে পরিলক্ষিত হয়।এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধকরাই হলেন নাথযোগী। প্রথমে তারা শুধুমাত্র লিঙ্গপূজা করলেও, পরবর্তীকালে দেবপাল শাসনের উত্তরকালে যখন এই দেউল নির্মাণ হয় ততদিনে তান্ত্রিক অনুষঙ্গ অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তার প্রভাবে লিঙ্গ-অালিঙ্গন মূর্তির প্রচলন শুরু হয়। জটার দেউলে লিঙ্গ যোনির প্রতিকী রূপদান ঘটেছে, তা এই প্রভাবেই।