মতামত

সুন্দরবনবাসির রক্ষাকর্তা বনের মা বনবিবি দেবী 

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

লেখার শুরুতে নিজস্ব কিছু কথা না বললে এই লেখাটি মনে হয় সম্পূর্ণ হবে না। জন্মের পর হইতে বড় হয়ে আমি দেখেছি, আমার বাড়ির লোকেরা শাসনকর্তা ছিলেন।দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার হোটরের রত্না গ্রামের সদ্দার পরিবারের যে রাজবাড়িটি ,সেই রাজবংশের বংশধর আমরা।ভাগ্যের পরিহাস আজ হয়তো আমরা সেই জায়গাতে নেই, সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে আমার প্রপিতামহ হেদিয়া বসবাস শুরু করেছিল। এখানকার জোরদার জমিদার হয়ে উঠেছিল, তবে ইংরেজ শাসন কালে ইংরেজদের সাথে মোকাবিলা করতে গিয়ে সে সম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেছিল। তার ফল পথে হয়েছিল সরদার পরিবার সকলকে। ছোটবেলায় আমার পিতা জ্যাঠামশাই ও পিসিমার অর্ধেক দিন অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। এ ঘটনা পাড়া-প্রতিবেশী সকলের  জানা, তবে আমরা দুবেলা-দুমুঠো নুন ভাত খেয়েও মানুষ হয়েছে। সুন্দরবন  বাঘের মুখে থেকে মাছ ধরে, বাজারে বিক্রয় করে, সেই উপার্জনের টাকায় আমাদেরকে মানুষ করেছে আমার পিতা ।সুন্দরবনের সেই ইতিহাস আজ আমি আমার বাবার মুখ থেকে যা শুনেছি এবং আমি নিজে বহুবার সুন্দর বনে ঘুরে যতোটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। আমার এই অনুসন্ধান এবং গবেষণা সুন্দরবনের তথ্য চিত্র শুরু করেছিলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্বপন দত্ত বাউলকে নিয়ে ।আজ আমি এসব কথা লেখার ইচ্ছা না থাকলেও গবেষণার মুহূর্তটাকে তুলে ধরতে বাধ্য হলাম।মানুষ সামাজিক জীব, সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করবার প্রয়োজনে নানা কর্মসূত্রকে আশ্রয় করে এক একটি সমাজ সে গড়ে তোলে নিজেরই পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য। মানব জীবন এগিয়ে চলে সমাজ – সংসার – প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিজস্ব বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে। সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে নিজেকে এবং নিজস্বতাকে প্রমাণ করতে চায়, তাই নিজস্বতার কারণে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। এই স্বাতন্ত্র্য শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রে নয়, তা সমাজেরও। এমনিই একটি সমাজ জীবন দেখতে পাব সুন্দরবনের লোকজীবনে এবং বনবিবি সংস্কৃতিতে। লোকায়ত সংস্কৃতি লোকসমাজের প্রতিটি মানুষের গোষ্ঠীগত ঐতিহ্যবাহিত এবং লালিত মহান সৃষ্টি।সুন্দরবনের ভৌগোলিক অবস্থান ঠিক কোন জায়গায় সেটি আমাদের অনেকেরই অজানা। তবে আজ আমারা এই লেখাতেই সবকিছু চিত্র ফুটে উঠবে ।বঙ্গোপসাগর উপকূলে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন। অষ্টাদশ শতকে বৃহত্তর সুন্দরবনের সীমানা একসময় কলকাতা অবধি বিস্তৃত ছিল। তখনকার সুন্দরবনের আয়তন ছিল, বর্তমানের সুন্দরবনের প্রায় দ্বিগুণ।বন কেটে আবাদ ভূমি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের আয়তন সঙ্কুচিত হতে হতে আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে।তবে আমরা স্বাধীনতার আগে যে সুন্দরবনকে দেখেছিলাম আজ সেই সুন্দরবন বিভক্ত দুটো ভাগে ভাগ হয়েছে। একদিকে বাংলাদেশ আরেকদিকে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের দুই  জেলা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত সুন্দরবন।
১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় সুন্দরবনের আয়তন ছিল প্রায় ২৫,৫০০ বর্গ কি:মি:, যার মধ্যে বর্তমানে ভারতীয় সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৯৬৩০ বর্গ কি:মি: এবং বাংলাদেশের সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১৫৮৭০ বর্গ কি:মি:। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত এই ভারতীয় সুন্দরবনের এলাকা।এই সুন্দরবন লাগোয়া শহরকেন্দ্রিক বন্দর ক্যানিংয়ে এসে লর্ড ক্যানিং ব্যবসা শুরু করেছিল।ব্রিটিশ সরকারের আমলাসহ পদাধিকারীরা সুন্দরবনের ঘুরে দেখেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন বিশ্বকবি হ্যামিলনের জন্য সুন্দরবনের এসেছিলেন।তবে সুন্দরবনকে নিয়ে বহু সাহিত্যিক, কবি ও লেখক এবং গবেষক বিভিন্ন বই লিখেছেন।তেমনি একজন লেখক বা গবেষক বললেও চলে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন সুন্দরবনকে নিয়ে। ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ্যাবিদ ডেভিড প্রেন ১৯০৩ সালে ‘বেঙ্গল প্ল্যান্টস’ নামে একটি বই লিখেন।সেই বইতে সুন্দরবনের ইতিহাস সম্পূর্ণ রুপে বর্ণনা করেছিল।তিনি যখন বইটি লিখেন, তখন বেঙ্গল বলতে বুঝিয়েছে তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকেই। এর মধ্যে পড়ে বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ড।আমরা আজ যে সুন্দরবনের জঙ্গল দেখছি, সেই সুন্দরবন একটা সময় বহু বছর আগে মানুষের বাসস্থান ছিল। কিভাবে মানুষের বাসস্থান টি ধ্বংস হয়ে, সুন্দরবন জল জঙ্গল আর জমিন হয়ে গেলো তার ইতিহাস স্পষ্ট ধারণা নেই আমাদের অনেকের কাছে। তিনি এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গাছপালার জরিপ করে বিবরণ দিয়েছেন তার বেঙ্গল প্লান্টস বইতে। তার এ বইটি পড়ে এখনো এই অঞ্চলের গাছপালা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করা যায়। প্রেনের মতে, সুন্দরবন নামটি এসেছে সুঁদরী (Heritiera minore, Roxb) গাছের নাম থেকে। কিন্তু সুঁদরী গাছ হয় কেবল সুন্দরবনের পশ্চিম ভাগে, যা পড়েছে বাংলাদেশের মধ্যে; কিন্তু সুন্দরবনের যে অংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে, সে অংশে প্রধান গাছ হলো গরান। ওই অংশে সুঁদরী গাছ ছিল না; কিন্তু তবুও ওই অংশকে বলা হয়েছে সুন্দরবন। যদিও বলা উচিত ছিল, গরান (Ceriops roxburghiana, Aran) বন; কিন্তু তা বলা হয়নি। অনেকে বলেন, সুন্দরবন নামটি এসেছে সমুদ্র-বন থেকে। সমুদ্র-বন বলতে বুঝিয়েছে সমুদ্রের ধারের বন। এই সুন্দরবনকে নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিনিয়ত চর্চা গবেষণা সবকিছু চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এর সঠিক হদিস গবেষকরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে ।সুন্দরবন পৃথিবীর মানচিত্র একটু অন্য কথা বলে যায়,বঙ্গোপসাগরের উপকূল এলাকায় ছোট ছোট শাখা নদীর মাঝে বিস্তীর্ণ বদ্বীপ তৈরি হয়েছে, আর সেই বদ্বীপ কে ঘিরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সুন্দরবন অবস্থিত।সুন্দরবন বেশির ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল নিয়েই সুন্দরবন।আজ যেখানে সুন্দরবন; অনেকের মতে, একসময় সেখানে বন ছিল না। ছিল জনবসতি। সুন্দরবনের মাটি খুঁড়ে শান বাঁধানো পুকুরঘাট ও বাড়ির ধ্বংসাবশেষ অবিষ্কৃত হয়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয়, ওই অঞ্চলে এক সময় জনবসতি ছিল। মেজর জেমস রেনল, যিনি প্রথম জরিপ করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানচিত্র আঁকেন (১৭৬৪-৭৬ খ্রি:), তিনি বলেছেন, তিনি বয়স্ক লোকদের মুখে শুনেছেন, একসময় সুন্দরবন ছিল না। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে ওই অঞ্চল থেকে মানুষ অন্যত্র চলে যায়। গড়ে ওঠে বনভূমি। সুন্দরবনের বয়স খুব বেশি নয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে ভারতের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশপরগনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে দু’টি সুন্দর কষ্টিপাথরের মূর্তি পেয়েছে। এই মূর্তি দু’টি কলকাতার বিখ্যাত ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ভারতের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অভিমত হলো, এখন পশ্চিমবঙ্গের যেখানে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন, একসময় সেখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। এই সুন্দরবনআঠারো ভাটির দেশ। সুন্দরবনে রাজ করে দানব দেবতা দক্ষিণরায়, তাঁর রাজত্বে পেটের টানে ঢুকে পড়া ভাটির মানুষদের বাঘ হয়ে খেয়ে ফেলে সে। বনবিবি আর তাঁর মুগুরধারী ভাই জঙ্গলি শাহ, সেখানে এসে যুদ্ধে হারায় দক্ষিণরায়কে। চুক্তিও হয়, বাদাবনের যে অংশে মানুষের বাস, তা থাকবে বনবিবির আঁচলের তলায়। আর গভীর দক্ষিণের জল-মাটি দক্ষিণ রায়ের থাবায়। সেই থেকে বাদাবন আর খাঁড়ি-জঙ্গলের মানুষের মা বনবিবি। রুটি-রুজির বড় বালাই, মানুষকে গ্রাম ছেড়ে বেরোতেই হবে, সেঁধোতেই হবে দক্ষিণ রায়ের ডেরায়। বনবিবি রাখলে, মারে কোন বাঘে? এ সুন্দরবনের জীবন্ত ইতিহাস, সুন্দরবনের ঝড়খালির দুই নম্বরে ফকির সরদার নামে এক বৃদ্ধ থাকতেন, তিনি বিদায় দিয়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দিতে পারতেন।যতবার মৎস্যজীবীরা বাঘের কবলে পড়ে জীবন দিয়েছে।তার ডেট বডি আনার সময় ফকির সরদার নিজে বাঘের সামনে দিয়ে ডেড বডি এনে দিয়েছেন, এ ইতিহাস জীবন্ত সত্য।আজও এই ঘটনার সাক্ষী রয়েছে সুন্দর বন বাসিরা।সেই কারনে সারা সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী দেবী। সুন্দরবনের মানুষ বিশ্বাস করেন, তিনি কখনও বাঘের আবার কখনও মুরগির রূপ ধারণ করেন। বাঘ ও বিভিন্ন অপদেবতার উপরে কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তিনি সুন্দরবনের বাউয়ালি (কাঠুরে) আর মৌলে (মধু সংগ্রহকারী), শিউলি ( খেজুর রস সংগ্রহকারী) ও মৎস্যজীবীদের রক্ষাকত্রী। হিন্দুই হোক বা মুসলমান,  সুন্দরবনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব তুলে দেন বনবিবির হাতে।সুন্দরবনের বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, মৎস্যজীবীরা ফকির সরদারের কাজ দিয়ে রক্ষাকবজ নিয়ে সুন্দরবন  নদীতে মাছ ধরতে যেতো। এ  স্মৃতিরা ১০ বছর আগে দেখেছেন সুন্দরবন বাসিরা, আজ আর ফকির সর্দার জীবিত নেই তাই স্মৃতিটা আস্তে আস্তে লুপ্ত হতে চলেছে! সুন্দরবন বাসিরা নিজের জীবিকার জন্য, সুন্দরবন এ কার্ড মধু ও মাছ সংগ্রহ করতে যেতে হয়।তাই সুন্দরবনে গভীর জঙ্গলে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বনবিবির  পূজা করে জলে নৌকা ভাসান। কারও উপরে কোনও আক্রোশ নেই এই পরমাসুন্দরী এবং ভক্তবৎসলা  দেবীর। বাঘ ও বিভিন্ন অপদেবতার উপরে কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তিনি হিন্দুর বনদুর্গা বা বনদেবীর মুসলমানি রূপ। তাই সুন্দরবনের  গভীর জঙ্গলে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বনবিবির  পূজা করে জলে নৌকা ভাসান।সুন্দরবনের ভেতরে আর বনসংলগ্ন লোকালয়ে প্রতিবছর পয়লা মাঘ ‘বনবিবি’র পূজা হয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে বনবিবি পূজিতা হন।সুন্দরবনের বনদেবতা বনবিবির কথা বলতে গেলে যে কথাটি না লিখলেও এই লেখাটি অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।সুন্দরবনে প্রথম জরীপ কার্য করেন শ্রী এল টি হজেস সাহেব, ১৮২৯ সালে। আর সেই কবে ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করেন, যখন  বন সংরক্ষণ নিয়ে ভারতবর্ষের অসংখ্য রাজা উজিরদের আদৌ কোন ধারণা ছিল কিনা সন্দেহ। ১৮৭৯ সালে সমগ্র সুন্দরবন কে বাঙলা বনবিভাগের আওতায় আনা হয়।সুন্দরবনের প্রথম বন্যপ্রাণ আধিকারিক হচ্ছেন এম ইউ গ্রীন সাহেব।১৮৮৪ সালে এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত হন।বর্তমানে ভারতীয় সুন্দরবন হচ্ছে ১০২ টি দ্বীপের সমষ্টি। এরমধ্যে ৫৪ টি দ্বীপে মনুষ্য বসতি আছে।১৭৩৭ সালের বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, সুন্দরবন মনুষ্যহীন পরিত্যক্ত স্থান হয়ে যায়। আবার মানুষের আবাদ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ১৭৭০ থেকে ১৯৩৬ এর মধ্যে। এটাই সুন্দরবনের শেষ আবাদ। অবশ্য ১৯৭৯ সালে দণ্ডকারণ্য থেকে অসংখ্য বাঙালি উদ্বাস্তু এসে সুন্দরবন সংলগ্ন মরিচঝাঁপি নামক একটি দ্বীপে বসতি স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁদের উদ্বাস্তু হবার আগে বাড়ি ছিল নিকটবর্তী বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। তারপর কি হয়েছিল সেই দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতি হয়ত অনেকের জানা আছে।আজ এসব সুন্দরবনের ইতিহাস, এই মরিচঝাঁপি এখনও মানুষের তেমনভাবে বসত গড়ে ওঠেনি। মরিচ ঝাঁপির ইতিহাসে রক্তে  ছাপ আজও মুছে যায়নি ইতিহাসের পাতা থেকে।এই মরিচঝাঁপি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন এক বৃদ্ধা, তিনি আজ এই পৃথিবীতে নেই। তিনি আমঝাড়া হাটখোলাতে বসবাস করতেন অঞ্জলি সরকার।বনবিবি দেবীর রক্ষা করেছিলেন তার পরিবারকে, একথা তার মুখ থেকে প্রকাশ পেয়েছিল নেওয়া সাক্ষাৎকারে বহু বছর আগেকার কথা।হেদিয়ার দুখিরাম সরদারকে স্বয়ং মা বনবিবি তাকে রক্ষা করেছিলেন ।এসব ইতিহাস সত্য, আজও মানুষের মুখে প্রকাশ পায়।সেই কারনে আদিম কাল থেকে শুধু নয় আজও দেব চেতনার পেছনে মানুষের, ভয়, বিস্ময় ও ভক্তি কাজ করেছে। আদিম মানুষ পাশের জগৎ জীবন ও তার বিস্ময়কর প্রকাশকে দেখে কোথাও বিস্মিত হয়েছে, আবার কোথাও ভয়ে বিভোর হয়েছে। তবে আজও সুন্দরবন বাসীরা বনবিবি দেবীকে বিশ্বাস করে,সেই কারনে সুন্দরবন বিভিন্ন জায়গায় বনবিবি দেবী পূজিত হন শুক্রবার দিনে।সেই আকস্মিকতার ঘোর কাটাতেই ব্যাঘ্র সম্পর্কিত একটি লোককাহিনি বনবিবি দেবীর উত্থান বলে মনে করা হয়। কাহিনীটি হল, ভয়ানক হিংস্র ও পরাক্রমশালী জঙ্গলের রাজা বাঘ, তার নিজস্ব গরিমার জন্য চিরকাল সবার সমীহ আদায় করে এসেছে। ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধার জন্য হয়তো প্রাচীন কাল থেকে মানুষ বাঘকে পুজো করে এসেছে।বর্তমানে সুন্দরবন বাসীরা  বাঘকে পূজা করেনা, বনবিবি দেবীকেই তারা পূজা করেন। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার ধ্বংসাবশেষে তার নিদর্শন মেলে। বঙ্গদেশে অনেক জায়গায় বাঘকে পুজো করা হয়। সুন্দরবনে বাঘ দক্ষিণারায় নামে দেবতা বলে প্রচলিত ও পূজিত। সুন্দরবনে বনবিবির মূর্তি তিনটি ধারায় বিবর্তিত হয়েছে। নদীর ধারে মাটির ঢিবি করে পূজা যেমন দেওয়া হয়ে থাকে, তেমনি ঘট পেতে পূজা করা হয়। মানত থাকলে অনেকে বনবিবির মূর্তিকে পূজা করে। আউলে, বাউলে, মোউলে, জেলে সবাই জঙ্গলে ঢোকার আগে বিশেষ ভক্তি সহকারে বনবিবির পূজা দেয়। কিন্তু বনবিবির পূজার কোনো নিয়ম নেই। ব্রাহ্মণ ছাড়াই ভক্তরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পূজা করে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই কিন্তু বিভিন্ন উপায়ে বাঘ-দেবতা ও বনবিবির পূজা করে। বিশ্বাস আছে যে এদের পূজা করলে জঙ্গলের বাঘ আক্রমণ করে না। সুন্দরবনের মানুষের বাঘের প্রতি ভয়, ভক্তি ও শ্রদ্ধার জন্য বাঘ এইভাবে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে আছে।তবে এখন আর মানুষ বাঘের দেখে ততটা ভয় করেনা, বাঘ হত্যা করে চোরাচালানকারীরা বিদেশে বিক্রি করে দিচ্ছে সুন্দরবন থেকে।বাঘের চামড়া ও বাঘের দাঁত প্রচুর টাকা পরিমাণে বিক্রি হয় এবং আজও তেমনি ভাবে এসব কাজ চলছে বহু গোপনে।এই লেখার মধ্যে বাঘের এ কথাটি উল্লেখ করার মনে, দক্ষিণরায় মানে বাঘ ,সুন্দরবনের রাজা ছিল ।আজও কিন্তু সেই রাজা,কিন্তু সে দক্ষিণরায় নামে পরিচিত ছিলো। তাহলে কিভাবে মানুষ রূপে ছিল এই দক্ষিণরায়  এ প্রশ্ন উত্তর বহু ভাবে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আজও তা মেলেনি।মূলত ‘বনবিবি-র জহুরনামা’ পুঁথির কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে যাত্রাপালা, পালাগান, পুঁথিপাঠ, নাট্যগীতি যা বনবিবি সংস্কৃতি নামে পরিচিত।শশাঙ্কশেখর দাস তাঁর ‘বনবিবি’ নামক গ্রন্থে জানাচ্ছেন – অবিভক্ত বাংলায় খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ভোমরা গ্রামের বাসিন্দা স্বর্গীয় বসিরউদ্দিন গাইন ভুরকুন্ডা দ্বীপের নীলআটি গ্রামে ‘বনবিবিযাত্রা’ প্রথম সূচনা করেন। তবে সুন্দরবনের ইতিহাস প্রায় চারশো  বছর আগের কথা। সুন্দরবনের মধ্যে ছিল এক গ্রাম। সেই গ্রামে বাপ হারা ছেলে দুখেকে নিয়ে বাস করতেন এক দরিদ্র রমণী। ফাইফরমাস খাটানোর নামে দুখে’কে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে নিয়ে যান দুখের জ্ঞাতি কাকা, পাশের গ্রামের দুই ধুরন্ধর ব্যবসায়ী ধনা আর মনা।সুন্দরবনের গ্রাম গঞ্জের বনবিবি যাত্রাপালা এই ইতিহাস দেখানো হয়। সুন্দরবনের জঙ্গলের জলে  নামার আগে দুখের মা দুখেকে বলেন, “বনে আমার মতো তোর আর এক মা আছেন। যখন কোনও বিপদে পড়বি তাঁকে ডাকবি। তিনি তোকে রক্ষা করবেন”। জলে ভাসলো মধুকরদের নৌকা। বনবিবির এই ইতিহাস সুন্দরবন বাসীদের জানা, দুঃখের এই কাহিনী আজও সুন্দরবন বাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য।সুন্দরবনে সে সময় বাস করতেন গাজী নামে এক আউলিয়া। আর জঙ্গল প্রহরায় থাকতেন বাঘরূপী অপশক্তি দক্ষিণ রায় বা রায়মনি। সারা সুন্দরবনের একছত্র অধিপতি এই দক্ষিণ রায়। যেমন সুপুরুষ, তেমন দাপট তেমন অহঙ্কার। গাজী আউলিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের বন্ধুত্ব ছিল।পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে সত্য ঘটনাকে উদঘাটন করা আছে, দুর্বল দুখেকে রক্ষা করেছিল বোনের মা বনবিবি।এই ইতিহাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই সুন্দরবন  বনবিবি আজও পূজিত হয় সুন্দরবন বাসীর কাছে।আর সেই ইতিহাস বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সুন্দরবন বাসির কাজ দিয়ে তথ্য নিয়ে  আজ আমি পরিবেশন করছি, আমার লেখনীর মাধ্যমে ।ওদিকে, সুন্দরবনের নদীপথে ব্যবসায়ী ধনা আর মনার নৌবহর ভেসে চলেছে ভাটির টানে। দুখের কাজে মন নেই, মায়ের জন্য তার প্রাণ কাঁদছে। ধনা আর মনার ভয়ে ফেরবার কথা বলতে পারে না। এক রাতে ধনা আর মনার স্বপ্নে দেখা দেন দক্ষিণ রায়। ধনা আর মনাকে স্বপ্নে তিনি বলেন,” আমি তোদের দুই ভাইকে প্রচুর মধু আর ধন সম্পত্তি দেবো। তোরা দুখে’কে আমার কাছে উৎসর্গ কর। না হলে তোদের নৌকা ডুবিয়ে দেবো”।লোভে আর ভয়ে ধনা আর মনা, দুখে’কে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ছল করে দুখে’কে একটি দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে পুকুর থেকে মিষ্টি জল নিয়ে আসতে বলে। সরলমতি দুখে নির্জন দ্বীপে নামে। ধনা আর মনা নৌকা ছেড়ে দেয়। দুখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।হঠাৎ তার মনে পড়ে, মা বলেছিলেন, বনের ভেতর দুখের আর এক মা আছে। মায়ের কথা মতো দুখে তখন সেই বনের মা’কে স্মরণ করে।  জলে জঙ্গলে আলোড়ন ওঠে। খুদে দুখের সামনে এসে দাঁড়ান অসামান্য রুপসী এক তরুণী বনবিবি, হাতে খোলা তলোয়ার।  কোলে তুলে নেন দুখে’কে। সব শুনে তাঁর চোখদু’টি রক্তজবার মতো লাল হয়ে ওঠে।
দুখে’কে আদর করে অনেক ধনরত্ন দিয়ে কুমিরের পিঠে চড়িয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। ক্রোধে আগুন বনবিবির আদেশে তখন বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী, যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে, বাঘরূপী দক্ষিণ রায় ও গাজী আউলিয়াকে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বন্দি করে বনবিবির কাছে নিয়ে আসেন।
গাজী আউলিয়া, দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির চরণতলে আশ্রয় নেন। দক্ষিণ রায় উপায় না দেখে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তারপর থেকে আরবকন্যা বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদায় পূজিতা হয়ে আসছেন শত শত বছর ধরে।এসব তথ্য আমার পিতার মুখের থেকে শোনার পরেও বনবিবির জহুরানামা নামে একটি বই থেকে জানতে পারা যায়, তিনি  হলেন ইব্রাহিম নামে এক সুফি ফকিরের কন্যা। ইব্রাহিম সুদূর আরব দেশের মদিনা থেকে আসেন বাংলায়। সঙ্গে আসেন তাঁর দুই স্ত্রী। ইব্রাহিমের প্রথম স্ত্রী গুলাল বিবি তাঁর সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হন। সুন্দরবনের জঙ্গলে গুলাল বিবির গর্ভে আরবদূহিতা বনবিবি ও তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলী জন্ম নেন। জন্মের পর থেকেই বনবিবির ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা সারা সুন্দরবনে প্রচারিত হয়ে যায়।আজও জঙ্গলের পশুপাখি থেকে মানুষ সবাই বনবিবির বশ হয়ে যায়। এ দিকে, যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনস্থ ভাটির দেশের রাজা ছিলেন  ব্যাঘ্ররূপী অপদেবতা দক্ষিণ রায়। তিনি ছিলেন সুন্দরবনের একছত্র অধিপতি। তিনি বনবিবির বশ্যতা মেনে নেন না। তাঁর অত্যাচার থেকে সুন্দরবনের মানুষদেরকে বাঁচানোর জন্য স্বর্গ থেকে আদেশ আসে মা বনবিবির কাছে।  তাঁর সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বনবিবির সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন।

Related Articles

Back to top button