পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো।
শুভাসিশ ঘোষ”প্রিয়তমা তোমায় অভিবাদন।ভয় নেই এমন দিন এনে দেবো সেনাবাহিনীর হাতে বন্দুক নয় শুধু গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ”কবির সুমনের কালজয়ী একটি বাংলা গানের প্রথম কয়েকটি লাইন,মনে আছে নব্বইয়ের দশকে বাঙালী জাতির বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই গানটি।সেই সময় থেকেই জীবন মুখী বাংলা গানের একটা চল শুরু হয়ে গিয়েছিল যা এই বাংলার প্রতিবাদী মানুষিকতার একটা নবতম ধারাকে সংযোজন করেছিল বলা যায়।বিদ্বান, রুচিশীল সংবেদনশীল, সংস্কৃতিবান বাঙালী কখনো কফি হাউসের আড্ডায় সোচ্চার থেকেছে তো কখনো কোলকাতার রাস্তায়। সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি অথবা পুলিশের ভারি বুটের শব্দটা আমাদের কাছে একটু বেশিই পরিচিত ছিল।যেটা আমাদের ষাট কিংবা সত্তর দশকের দিনগুলোর কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়।তখন প্রিয়তমার চোখে চোখ রেখে সমাজ বদলের আমরা স্বপ্ন দেখা বাঙালী সেদিন কোলকাতার কোনো বস্তির স্যাঁতসেঁতে শেওলা জমা একফালি ঘরে চাড় মিনার মুখে এক নতুন ভোরের কথা ভেবে নিজেকে বাজি ধরতাম।এক আপোষহীন,সাংঘাতিক লড়াকু চেতনার লিকলিকে হাড় জীরজীর বাঙালী তখন বারবার বীর বিক্রমে পুলিশের বন্দুক,ভারি বুটের আওয়াজ, কিংবা সেনাবাহিনীর চোখ রাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজের বুকের কলিজা সঁপে দিতো এক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে।এই বাঙালী অতীতে জন্ম দিয়েছে এমন কিছু দামাল সন্তানকে যাদের অস্থিমজ্জায় ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র, বিনয় বাদল দীনেশ, ক্ষদীরাম প্রফুল্ল চাকির মতো বিপ্লবী। ষাটের দশকে আগুন খেঁকো বিপ্লবী চারু মজুমদার, জঙ্গল সাঁওতাল, কানু সান্যাল, এদের মতবাদ যাই থাকুক পথ চলার ক্ষেত্রে বিস্তর বাধা ভুল ঝুঁখ থাকলেও তাদের দেশ ও সমাজের প্রতি একটা দায় ছিল। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তাদের বলি প্রদত্ত জীবনকে আমাদের তাই আজও কুর্নিশ করতে হয়। যেখানে প্রিয়তমার আঁচলে গোলাপের পাপড়ি ভরে দেওয়া আর সাঁজোয়া গাড়ির সামনে নিজের শীর্ণকায় শরীর পেতে দেওয়ার মধ্যে যে সুখের অনুভুতি ছিল সেই অনুভুতির তিল মাত্র আজ আর নেই। সেই বাঙালীর শরীরে মনে আজ বাসা বেঁধেছে কুপমুন্ডক কলুষতা দালালি।যে বাঙালী আজ করোনা ভাইরাসের আবর্তে বেঁচে থাকার জন্য অন্তিম রসদ খুঁজতে মদের দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিবেক বর্জিত, নপুংসক, এই বাঙ্গালীকে আজ যেন বড়ই অচেনা মনে হয়। যাদের অস্থিমজ্জায় আজকে বিষবৃক্ষের পচোন ধরেছে।যার শেষটা দেখার জন্য এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।তাই মাটিতে অনেক অনাহার, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘরে ফেরা লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই বাতাস ভারি করা ক্রন্দন রোল আজ আর আমাদের কানে পৌছায় না।আমরা ভুলেছি নিকষ কাল অন্ধকারে দাঁড়িয়েও আলোর সন্ধানে পথ হাতরানো মানুষদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা।যে বাঙালী একদিন তার গনপ্রতিবাদের অগ্নীশিখায় এই দেশের মানুষদের পথ দেখিয়েছে, যাদের রক্তে নাচে বিদ্রোহের সুর আজকের দিনে সেই বাঙালী গোমাতার গোমূত্র সেবন আর তোষনকেই একমাত্র ভরসা মনে করে।তাই প্রিয়তমার অভিবাদনে আর গোলাপের পাপড়ি ঝরে না।পরিবর্তে হেলিকপ্টার থেকে ঝরে পরা গোলাপ ফুলের পাপড়ির প্রতিটিতে লেগে থাকে অবর্ণনীয় কষ্ট আর বঞ্চনার কথা।যা প্রিয়তমার জন্য নয়।