কাকাবাবু হেরে গেলেন
সঞ্জয়় মুখোপাধ্যায: সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন সিনেমাটোগ্রাফার বৈদ্যনাথ বসাক। বৃহস্পতিবার ৩.৩০ এর সময় মারা যান এই প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার । মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। জীবনের দীর্ঘ সময় মহানায়ক উত্তম কুমারের ছবির কাজ করেছেন এই সিনেমাটোগ্রাফার। তবে তার জীবন শুরু হয়েছিল বিভূতি লাহার হাত ধরেই বাংলা সিনেমা জগতের চলার পথে।বিভূতি লাহা ছিলেন ভীষণ রাসভারী মানুষ। সামনেই যাওয়া যেতো না। সেই মানুষই একদিন এন.টি.ওয়ান স্টুডিওতে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলেন বৈদ্যনাথ বাবুর সাথে দেখা করার জন্য। “এভাবেই ইত:স্থত স্মৃতি হাতড়ে ফিরতেন বৈদ্যনাথ বসাক ওরফে বি এন বসাক। উত্তমকুমার ভীষণ ভালোবাসতেন। কৃষ্ণ-সুদামা ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন তিনি। প্রযোজককে বলেছিলেন এই ছবি আপনাকে অনেক পয়সা দেবে। সত্যি সত্যি তিনি এই ছবি করে কোটিপতি হয়েছিলেন।বসাক চিরকালই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন ছবির ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন সারা পৃথিবী জুড়ে খ্যাতমান ফটোগ্রাফার আজ কাকাবাবু হেরে গেলেন। সবাইকে ছেড়ে নিমিষের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে হারিয়ে গেছে পরপারে।এত বড় একটি ফটোগ্রাফারের জীবনের শেষ পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে গেছিল এই বাংলার বুকে।বাংলায় যোগ্য মানুষের সম্মান আজও দিতে পারেনি, সে সিনেমা জগৎ বা সংবাদমাধ্যম জগত হোক, বা অন্যান্য জগতের হোক। তবু তিনি হারতে শেখেনি জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে দীর্ঘ চার কিলোমিটার পথ হেঁটে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন সন্ধানে। সে দৃশ্য আজ ভোলার নেই,
রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের অন্নপূর্ণা প্রকল্পে প্রতিদিন দুপুরে পাত পড়ে পঞ্চাশের বেশি। অনেকেই আসেন। ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সম্বলহীন মানুষ। তাঁদের সঙ্গে পঙ্ক্তিভোজনে রোজই সামিল হতেন আরও বৈদ্যনাথ। যদি একটু গরম ভাত মেলে।খাওয়া শেষে নিজের থালা নিজেই ধুয়ে ভরে নিতেন হাতের ঝোলায়। তার পর খানিক বিশ্রাম আশ্রমের কোনও গাছের ছায়ায়। বেলা গড়ালে ফের অশক্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেন দু’কিলোমিটার দূরে পশ্চিম পানশিলার খালপাড়ের একচিলতে ঘরটাতে। দুপুরে খাওয়ার জন্য যাতায়াত মিলিয়ে রোজ হাঁটতেন অন্তত চার কিলোমিটার পথ। যাঁদের সঙ্গে রোজ খান, তাঁরা তাকে চিনতেন না। পড়শিদের কাছেও তাঁর বিশেষ কোনও পরিচয় নেই। তবেই ভীষণ শান্ত ও লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। বহু পরিচালক ও প্রযোজক তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিতেন না। সামান্যতেও অফুরন্ত হাসিখুশি ও শিশুসুলভ হয়ে উঠতেন। এই সুযোগে অনেকেই তাকে ব্যহার করেছেন। মুম্বাইতে থাকাকালীন রাজ কাপুরের সাথে ‘বুট পলিশ’ সহ কিতনে পাস ‘কিতনে দূর’, মনোজ কুমার গোস্বামী, মালা সিন্হা, শশী কলা অভিনীত ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’ ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন বি.এন.বসাক । তদানীন্তন বোম্বাইতে তিনি এই নামেই খ্যাত ছিলেন।বৈদ্যনাথ বসাক আরো যে যে ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন তা হ’ল- অগ্নি পরীক্ষা, সবার উপরে, লালু ভুলু, সাগরিকা, সোনার খাঁচা, সূর্য সাক্ষী, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, নাইকা সংবাদ, অপরাহ্নের আলো ইত্যাদি। এছাড়া তার কথায় তিনি অনেক উড়ে ভাষা ও খোট্টা ভাষার সিনেমাতে ক্যামেরা চালিয়েছেন। বন্ড সই করে একজন সহযোগী নিয়ে রাজস্থানের তামার খানির মধ্যে ৭০০০ ফুট গভীরে ক্যামেরা নিয়ে যান। তাঁর সহযোগী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি একা প্রয়োজনীয় সব সুটিং নিজে করেন।তবে তার জীবনের শুরু আর শেষ মুহূর্ত টা কে এক স্মরণীয় ঘটনা আমাদের কাছে।১৯৪৭ সাল। দেশ তখন সবে স্বাধীনতা পেয়েছ। কলকাতায় বিভূতি লাহার কাছে প্রথম কাজের শুরু। এর পরেই তিনি ডাক পান মুম্বই, তৎকালীন ‘বম্বে ইন্ডাস্ট্রি’তে। সুযোগ হয় রাজ কাপুরের সঙ্গে কাজ করার। ‘বুট পালিশ’ ছবির সাফল্য তখন বৈদ্যনাথ বসাককে অনেকটাই পরিচিতি দিয়েছে, কিন্তু তাঁর মন পড়ে রয়েছে কলকাতার টালিগঞ্জে। ফিরে আসতে চাইলে বাধা দেন রাজ কাপুর, বলেন সামনেই ‘শ্রী৪২০’-এর শ্যুটিং শুরু। তাই তাঁর যাওয়া হবে না। কিন্তু নাছোড় বৈদ্যনাথ ফিরে আসেন কলকাতা। আর শুরু হয় নতুন যাত্রা উত্তমকুমারের সঙ্গে। ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫), খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন(১৯৬০)এ চলেছে তাঁর ক্যামেরা। সাদা কালো থেক রঙিন ছবির পরিবর্তন ক্যামেরায় ধরে রখেছেন তিনি। এর পরে শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়, ওড়িয়া মালায়ালাম, বিহার সব ইন্ডাস্ট্রিতেই সমান তালে কাজ করেছেন। নেপালের রাজার সঙ্গে কাজ করেছেন। এসব আজকের দিনের ইতিহাস। আর এই ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার’স এন্ড ডিরেক্টর’ অ্যাসোসিয়েশনের এর সাধারণ সম্পাদক বিমল দে, বৈদ্যনাথ বসাক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, অভিনেতারা ক্যামেরার সামনে থাকেন মানুষ তাই অভিনেতাদের পর্দায় দেখতে পান। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া একটি সিনেমা তৈরি হতে পারে না। কিন্তু তারা সব সময় ক্যামেরার পেছনে থাকেন। মানুষ তাদের দেখতে পায় না ঠিকই কিন্তু তাদের শিল্পকর্মই সাফল্য আনে একটি চলচ্চিত্রের। বৈদ্যনাথ বসা এরকম একজন মানুষ ছিলেন। একজন গুণী মানুষ কে টলিউড হারালো। বেহুলা লক্ষিন্দর সিনেমা বিমল বাবু তখন সহকারি পরিচালক। সেই সিনেমা কাজ করেছেন বৈদ্যনাথ বসা। তার অসাধারণ ক্যামেরা শিল্পকর্মের কথা তিনি কোনদিন ভুলতে পারবেন না বলে জানান বিমল দে ।অন্যদিকে ইন্ডিয়া মোশন পিকচার কালচারাল কনফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক সাধন তালুকদার বসাক পরিবারের পাশে থেকে সমবেদনা জানিয়েছে,বৈদ্যনাথ বসাকের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।বৈদ্যনাথ বসাকের ছেলে সঞ্জয় বসাক এর পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি এও বলেন
শিল্পকর্মের অসাধারণ নৈপুন্যতা থাকা সত্ত্বেও বৈদ্যনাথ বসাকের আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল নিত্যসঙ্গী। শেষ বয়সে এসে দুর্দশার মধ্যে জীবন কেটেছে তার। কোন কোনদিন অর্ধাহারে ও জীবন কেটেছে তার। আজ কতটা তার পরিবারের পাশে থাকতে পারবো, সেটা বলার অপেক্ষা নেই। তবে বৈদ্যনাথ বসাকের ছেলে সঞ্জয় বসাক জানান, আর্থিক সঙ্গতি এখন এতটাই খারাপ তাদের যে তার বাবার শেষ কাজটুকু করতেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।