আত্মাশুদ্ধি

সতীপীঠের অন্যতম কামাখ্যা মন্দির ~তন্ত্রসাধকদের এক অনন্য পবিত্র তীর্থ

মৃত্যুঞ্জয় সরদার:ছোটবেলায় গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতাম তবে এমন গল্প শুনেছি ঠাকুরদা ঠাকুরমার কাজ দিয়ে কামাখ্যায় দশমহাবিদ্যা পারদর্শী হয়ে বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তির পরিপূর্ণ মানব। এও শুনেছি পড়ি নামক কোন সুন্দরী মহিলা এসে পবিত্র সুন্দর ছেলে ও মেয়েদেরকে নাকি তুলে নিয়ে চলে যায় পরী। এসব ছিল গল্প কথা। বহু মানুষ  গিয়ে সতীপীঠের অন্যতম কামাখ্যা মন্দির ~তন্ত্রসাধকদের এক অনন্য পবিত্র তীর্থ , দশমহাবিদ্যা সাধনা লাভ করেছে অনেকে । ছোটবেলা থেকে কামাখ্যা যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল থাকলেও আজকের দিন পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কামাখ্যা নাগা সাধু থানা প্রতি নিত্যানন্দগিরি মোহন্ত নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আমার এক সাক্ষাৎকার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। নাগা সন্ন্যাসীর ইতিহাস আজকের দিনে অনেকের কাছে অজানা হলেও নাগাদের নিয়ে অনেক গল্প কথা রয়েছে। থানাপ্রতি নিত্যানন্দগিরি মোহন্ত  সাধুদের সাধন ভজন ও সাধারণ যাত্রীদের অন্ন সেবা দেন। তবে এই বগলামুখী মা কামাখ্যা দেবী মায়ের চরণে মাথা ছুঁইয়ে নিজের মনের কথা জানানোর আকুতি আমার রয়েছে, তবে মা আমাকে ওখানে ডাকবেন কিনা সেটা সব মায়ের ইচ্ছা। তাই কামাখ্যার ইতিকথা আমারে কলমে আজকের দিনে প্রকাশ করছি।কামাখ্যা মন্দির হচ্ছে ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত। হিন্দু দেবী কামাখ্যার মন্দিরটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম।এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী এবং কমলা এই দশ দেবীর মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী এবং কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ। কামাখ্যা মন্দিরের অধিষ্ঠান, এটির থেকে অনূমিত হয় মূল মন্দিরটি নাগারা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির ছিল।
কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে, গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ যেগুলোর স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন এবং নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। সেগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। অসমের বিশেষ করে গুয়াহাটির বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়। গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। সেখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে ওখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। সেটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। সেই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেই একই রকম আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ জল দ্বারা পূর্ণ থাকে। বর্তমান মন্দির ভবনটি অহোম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। তার মধ্যে প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ১৫৬৫ সাল নাগাদ কোচ রাজা চিলরায় মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে দেন। এখন যে মৌচাক আকারের চূড়াটি দেখা যায় তা নিম্ন অসমের মন্দির স্থাপত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরের বাইরে গণেশ এবং অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি খোদিত আছে। মন্দিরের তিনটি প্রধান কক্ষ। পশ্চিমের কক্ষটি বৃহৎ এবং আয়তাকার। সাধারণ তীর্থযাত্রীরা এটি পূজার জন্য ব্যবহার করেন না। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবীর একটি ছোটো মূর্তি আছে। সেই মূর্তিটি পরবর্তীকালে এখানে স্থাপিত হয়। সেই কক্ষের দেয়ালে নরনারায়ণ, অন্যান্য দেবদেবী এবং তৎসম্পর্কিত শিলালেখ খোদিত আছে। মাঝের কক্ষটিই মূল গর্ভগৃহে নিয়ে যায়। সেটি গুহার আকৃতিবিশিষ্ট। সেখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু যোনি আকৃতিবিশিষ্ট পাথর এবং ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনটি আছে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয়। সে সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবনের জল আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে লাল হয়ে থাকে। ফলে সেটিকে ঋতুস্রাবের মতো দেখতে হয়।
    তাই বলবো  যোনি আকৃতিবিশিষ্ট পাথর এবং ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনটি প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে ৩৫০ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ এবং সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং এর রচনাতেও কামাখ্যা উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হত। নবম শতাব্দীতে ম্লেচ্ছ রাজবংশের বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার শিলালিপি উল্লেখ পাওয়া যায়।সেই শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীতে সেখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে সুলেমান কিরানির ১৫৬৬ থেকে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য ক্রামণ করার সময় ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কথিত আছে কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। তিনিই এই মন্দিরে পূজার পুনর্প্রবর্তন করেন। তবে তাঁর পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড় করে তোলেন। অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়। জনশ্রুতি অনুসারে কোচবিহার রাজপরিবারকে দেবী কামাখ্যাই পূজার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোচবিহার রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ভিন্ন এই মন্দির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ১৬৫৮ সালে অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ নিম্ন আসাম জয় করলে এই মন্দির সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অহোম রাজারা শাক্ত বা শৈব ধর্মাবলম্বী হতেন। তারাই এই মন্দির সংস্কার এবং পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতেন। রুদ্র সিংহ রাজত্বকালে ১৬৯৬ থেকে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে বৃদ্ধবয়সে গুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রজা ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করতে পারবেন না বলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে দূত পাঠালেন। নদিয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে মালিপোতার বিশিষ্ট শাক্ত পণ্ডিত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে তিনি অসমে আসার অনুরোধ জানালেন। কৃষ্ণরাম জানালেন কামাখ্যা মন্দিরের দায়িত্ব দিলে তবেই তিনি অসম যাবেন। রাজা নিজে দীক্ষা না নিলেও তার পুত্রদের এবং অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কৃষ্ণরামের কাছে দীক্ষা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।রুদ্র সিংহের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র শিব সিংহ ১৭১৪ থেকে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন । তিনি কামাখ্যা মন্দির এবং পার্শ্ববর্তী বিরাট একটি ভূখণ্ড কৃষ্ণরামকে দেবত্তোর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। তাকে ও তার বংশধরদের পর্বতীয়া গোসাই বলা হত। কারন তারা নীলাচল পর্বতের উপর থাকতেন। কামাখ্যা মন্দিরের অনেক পুরোহিত এবং আসামের অনেক আধুনিক শাক্ত এই পর্বতীয়া গোসাইদের শিষ্য। অনুমিত হয় প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসি উপজাতির বলিদানের জায়গা। এখনও বলিদান এখানে পূজার অঙ্গ। এখানে অনেক ভক্তই দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগলবলি দেন। কালিকা পুরাণ অনুসারে কামাখ্যায় পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। শিবের তরুণী স্ত্রী এবং মোক্ষদাত্রী শক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত। ১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মঙ্গোলরা আক্রমণ করলে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় তান্ত্রিক মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল মুসলমান আক্রমণের সময়। আসামের অন্যান্য দেবীদের মতো দেবী কামাখ্যার পূজাতেও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়।দেবীকে যেসব নামে পূজা করা হয় তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেবদেবীর নাম আছে। যোগিনী তন্ত্র অনুসারে এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস কিরাতদের ধর্ম। বাণীকান্ত কাকতির মতে গারো উপজাতির মানুষেরা কামাখ্যায় শূকর বলি দিত। এই প্রথা নরনারায়ণ কর্তৃক নিযুক্ত পুরোহিতদের মধ্যেও দেখা যেত।কামাখ্যার পূজা বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয় মতেই হয়। সাধারণত ফুল দিয়েই পূজা দেয়া হয়। মাঝে মাঝে পশুবলি হয়। স্ত্রীপশু বলি সাধারণত নিষিদ্ধ হলেও বহু পশুবলির ক্ষেত্রে এই নিয়মে ছাড় দেয়া হয়।

Related Articles

Back to top button