মতামত

বই পড়ার অভ্যাস গাণিতিকহারে কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, সেই হারে পাঠক বাড়েনি!

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

বই পড়ার অভ্যাস হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। কারণ, শৈশবই ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম পর্ব। বছর তিরিশ পিছিয়ে গেলেই অন্য ছবি ধরা পড়ে। তখন ছেলেবেলা ছিল বড্ড মজার। ছোটরা লেখাপড়ার ফাঁকে মাঠেঘাটে দাপিয়ে বেড়াত। বর্যার কাদামাঠে ফুটবল কিংবা শীতের দুপুরের ক্রিকেটের মজাই ছিল আলাদা। দল বেঁধে স্কুল যাওয়ার মধ্যেও ছিল এক অন্য রকম  আনন্দ। সে সময় যৌথ পরিবার ছিল। অফুরন্ত আদর ভালবাসা ও আত্মিক বন্ধন ছিল। ঠাকুমার ঝুলি, আবোলতাবোল, বুড়ো আংলা, হযবরল-র আশ্চর্যময় কল্পনার জগৎ ছিল।
বইয়ের প্রযুক্তি বহু আগের। এখন শুধু প্রযুক্তির বিবর্তন হচ্ছে। এখানে যারা বললেন তাদের অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি- বই থাকবে, কিন্তু বইয়ের বিবর্তন হবে। পশ্চিমে আমি দেখেছি- একসময় কিন্ডল গেল, একটা কিন্ডল হচ্ছে- যেখানে পাতা উল্টানোও দেখা যায়। আমার একটা কিন্ডল আছে- সেখানে দশ হাজার বই আছে।প্রযুক্তি আর মানুষের ভোগবাদিতা কিন্তু এই বৃষ্টিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে, হিমালয় আর মেরুর বরফকে গলিয়ে দিচ্ছে, নদীগুলো মরে যাচ্ছে, খনিজসম্পদ তুলে তুলে শূন্য করে দিচ্ছে পৃথিবীর জঠর, ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠছে মাটির অভ্যন্তর আর ছিঁড়ে খুবলে তছনছ করে ফেলা হচ্ছে ওজন-লেয়ারকে! ফলে শুরু হয়েছে ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয়। ঝড়ে, বন্যায়, ভূমিকম্পে আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে- বা ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ‘কেয়ামতের আগে মাথার ওপর সুরুজ’- নেমে আসায় মানবসভ্যতা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। অথচ এ প্রযুক্তিই একদা মানুষকে অন্যান্য প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে র‌্যাশনাল অ্যানিমেলে রূপান্তরিত করেছিল। মানুষ পাথর ছুড়ে বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে ও খাদ্যাদি সংগ্রহ করে, আগুন জ্বেলে, লোহা ব্যবহার করে, গুহার দেয়ালে এঁকে-লিখে, গাছের ছালপাতা-চামড়া-পাথরে লিখে লিখে আজকের কাগজে মুদ্রিত বইতে এবং সেই সঙ্গে আজকের এই মানুষে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। এর সবই প্রযুক্তিরই মধ্য দিয়ে হয়েছে। আজকের, আমার হাতের এই মুদ্রিত বইটিও প্রযুক্তিরই। কথা হচ্ছে, এই প্রযুক্তিই এখন ই-বুক, বিদ্যুৎ-বই এমনকি, হয়তো, থ্রি-ডাইমেনশনাল-তিন মাত্রার-বই তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা পাঠকের সংঙ্গে পাঠ ও বইয়ের সম্পর্ক নষ্ট করবে কিনা, বিরহ-বিচ্ছেদ তৈরি করবে কিনা, এই প্রশ্নটি উত্থাপন করছে।

 

 

আমাদের আশঙ্কা, করতেও পারে। ইন দ্যাট কেইস, যদি করে, আমরা কী করব? ইয়েপ, আমরা প্রযুক্তির সেই বইগুলো পড়ব না এবং আমরা প্রযুক্তির সেই অগ্রগতিকে থমিয়ে দেব। প্রযুক্তির বল্গাহীন ঘোড়ার বল্গাকে টেনে ধরব, তাইনা? আমরা তো সেই প্রযুক্তিরই বই পড়ব যে প্রযুক্তির বই আমাদের কমফোর্ট দেবে! কেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির তৈরি-করা পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের প্রযুক্তিকে কি আমরা থামিয়ে রাখছি না? পাঠক ছিল, আছে, থাকবে। আজকের বইটিও একটি প্রযুক্তিরই ফসল। আমরা বই ধরব, গন্ধ নেব, ইচ্ছা মতো বসে, শুয়ে, কাত হয়ে, চিত হয়ে যেমন খুশি পড়ব- প্রযুক্তির যে বইটি পাঠককে আরাম করে পড়তে দেবে!সত্যি কথা বলতে কি বই পড়ার অভ্যাস গাণিতিকহারে কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, সেই হারে পাঠক বাড়েনি। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত বিদ্যালয় আর কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য বই পড়তে আগ্রহ হারাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে ব্যাপক অংশ ইন্টারনেট, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি ঝুঁকেছে। তবেই বাংলার গ্রাম গঞ্জের দেখতে পাই ছোট ছোট বইমেলা।বইয়ের পাঠক সংখ্যা কি অনেকটাই কমেছে না ভবিষ্যতে পাঠক সংখ্যা বেড়ে চলেছে এটা নিয়ে প্রশ্ন সবার মুখে মুখে?তবে বিভিন্ন বইমেলাতে সমাজের যে বার্তাটি যায় বই বিক্রেতা সংখ্যা অনেকটাই কমেছে!কিন্তু কেন শিক্ষার এত উন্নতি হওয়ার পড়ে বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমেছে, এর জন্য কি অনলাইনমিডিয়া এরাই দায়ী? নাকি সোশ্যাল মিডিয়া মানুষ সবকিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাঠক সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।এই নিয়ে আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু পাঠক সমাজের কাছে, পাঠকদের সামনে তুলে ধরবো আমার কলমে।এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে পৌঁছে যেতে হবে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়৷ বুঝতে হবে, বছরভর বাংলা বই প্রকাশনার বাণিজ্যটি৷ পাবলিশার্স এবং গিল্ডের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর কলেজ স্ট্রিটে প্রায় আড়াই হাজার নতুন বই মুদ্রিত হয়৷ সংখ্যাটি নেহাত কম নয়৷ ছোটবড় মিলিয়ে কলেজ স্ট্রিটে মোট প্রকাশকের সংখ্যা পাঁচশ’রও বেশি৷ সুতরাং গড়ে প্রত্যেক প্রকাশনা বছরে পাঁচটি করে নতুন বই প্রকাশ করছে৷ বিশ্ববাজারে এ সংখ্যা নেহাত মামুলি নয়৷ কিন্তু যাচ্ছে কোথায় সেই বই? আদৌ বিক্রি হচ্ছে তো? প্রকাশকেরা সেই বই নিয়ে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন তো? মনে রাখা দরকার, নতুন প্রকাশিত অধিকাংশ বই-ই বইমেলাকে মাথায় রেখে করা হয়৷ পুজোয় যেমন বহু প্রকাশনা পুজো সংখ্যার ম্যাগাজিন প্রকাশ করে, তেমনই বইমেলায় প্রকাশিত হয় নতুন বই৷ অভিযোগ, বড় প্রকাশনাগুলি ছাড়া অধিকাংশ প্রকাশকই ইদানীং নিজেদের খরচে নতুন বই প্রকাশ করে না৷ লেখকই নিজের বই ছাপার অর্থ দেন৷ অর্থাৎ, বই বিক্রির প্রাথমিক তাগিদ না দেখালেও চলে ছোট প্রকাশকদের৷ লেখকের থেকেই তারা প্রোডাকশনের অর্থ তুলে নেন৷ তাছাড়া যে লেখক নিজের অর্থে বই ছাপান, সেই লেখকের গুণমান নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়৷

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলার নিরিখে তৃতীয় স্থানে আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা৷ প্রথম স্থানে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট, দ্বিতীয় লন্ডন৷ আর দৈনিক ভিড়ের হিসেব ধরলে, কলকাতা বইমেলা সকলের উপরে৷ সব মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ২ মিলিয়ন, অর্থাৎ ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়৷ বইয়ের পাশাপাশি আড্ডা, সেমিনার, গানবাজনা, সবই চলতে থাকে এখানে৷কি কেন্দ্র কি রাজ্য সরকারের একটা বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া খুবই দরকার বলে মনে করছেন অনেকেই,প্রতিটি গ্রাম অঞ্চলে একটি করে লাইবারি তৈরি করা।সেইসব লাইবারি থেকে ডব্লুবিসিএস ও সমস্ত চাকরি-বাকরির ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা সরকারি ভাবে।এভাবেই আগামীদিনের বইয়ের পাঠক সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে সরকারকেই!অসহায় গরীব ছেলে মেয়েদের জন্য কিছু পাঠ্যপুস্তক যদি এসব লাইব্রেরীতে রেখে দেয়, উচ্চশিক্ষার জন্য। তাহলে সেখান থেকে পড়াশোনা করে অসহায় ছেলে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। তবে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?এরকম উদ্যোগ আজও দেখিনি কোনো সরকারকে নিতে কি কেন্দ্র-রাজ্য! এ যুগে বই পড়ার ঝোঁক কমছে বলে অনুযোগ শোনা যায় হামেশাই। সাধারণ মানুষের এই ‘বই বিমুখতা’র কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তার নানা দিক আমাদের সামনে ধরা দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তারই হাত ধরে আজ সবার কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুলভ সুযোগ এসে পৌঁছেছে। সেই সূত্রেই বর্তমান তরুণ সমাজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন মাধ্যমকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ডুব দিয়েছে। টেলিভিশনও অবশ্য কম দায়ী নয়। যাই হোক, এ সবের ফলস্বরূপ পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে। অনলাইন নির্ভরতার যুগে এ পরিসংখ্যান অনেকটা আশার খবর হলেও ঈদ, পূজা ও পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসবের বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে আছে বইমেলা। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগঠন এফইএবি সূত্র বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশিয় বাজারে পোশাক বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫শ কোটি টাকার। শুধু ঈদ-উল-ফিতরের আগে বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বাকিটা বিক্রি হয়েছে পহেলা বৈশাখ, ঈদুল আযহা, দুর্গা পূজা এবং পহেলা ফাল্গুনসহ বিভিন্ন উৎসবসহ সারা বছরে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বইয়ের হার্ড কপির পাশাপাশি এখন ইন্টারনেটে সফটকপি পড়ার সুযোগ থাকলেও ই-বুক পড়ে এমন পাঠকের সংখ্যা হাতে গোনা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটে গেম খেলার সর্বনেশে নেশা।
এখন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়া ব্যাপারটা শুধুই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর অনলাইনের কিছু পত্র-পত্রিকায় সীমায়িত। ‘ই –বুক’-এর প্রচলন হলেও তা কি হাতে বই নিয়ে পড়ার স্বাদ দিতে পারে? প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এই যে এত বেশি ঝোঁক, তার পরিণতি কিন্তু সুখকর নয়।এ হিসাবে দেখা যায়, ফ্যাশনের দিক থেকে মানুষ খুব দ্রুত আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও সে হারে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী নন। অথচ একটা সময় ছিল যখন কিশোর-তরুণদের অবসর সময়ের বড় একটা অংশ কাটতো বই পড়ে। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে শিশু-কিশোররা বই কিনতো। কিন্তু মানুষের বই কেনার অভ্যাস কমে যাওয়ায় বর্তমানে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটসহ সারা দেশে বইয়ের দোকানের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। তার বদলে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে খাবার-দাবার, ফ্যাশন হাউস। এজন্য অবশ্য লেখকরাও কম দায়ী নন।

এখন আর সমাজমুখী লেখা তেমন একটা পাওয়া যায় না। আর মানুষদের বইমুখী করতে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগও তেমন দৃশ্যমান নয়। তাই ভালো মানের মননশীল বইয়ের পাঠ্যাভ্যাস কমে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম জঙ্গিবাদের মতো খারাপ দিকে ঝুঁকে পড়ার ঘটনাও আমরা দেখছি। আমরা মনে করি, এ দৈন্যদশা থেকে মুক্তি ও মননশীল প্রজন্ম পেতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি লেখক-প্রকাশক, অভিভাবকসহ সবাইকে এ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে হবে। এ সময়টাই যে কবিতা লিখে চিঠি পাঠানোর নয়, সময়টা এখন রিমোট কন্ট্রোল, ইন্টারনেট, এসএমএস,  ই-মেইল, ভাইবার, টেঙ্গু কিংবা ক্লিকের সময়, কর্পোরেট ব্যস্ততার সময়।  গতির সাথে পাল­া দিয়ে ছুটেচলা।  হাইটেক গে­াবাল ভিলেজে এখন আর চিঠিতে মন ভরছে না।  অবশ্য চিঠি লেখার সময়ই বা কোথায়? মুঠোফোন, ইন্টারনেট, চ্যাট, ই-মেইল, এসএমএস এবং ফেসবুকের গতির ধাক্কায় চিঠি এখন আর লেখা হয় না।  চিঠি সময়সাপেক্ষ বলে এ যুগে আর খাপ খাইছে না।  যে কারণে ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম, বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম’ গানগুলোও যেন তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে।  এখন শুধুমাত্র অফিসিয়াল চিঠি ছাড়া আর চিঠি লেখা হয় না।  একসময় বাবার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের চিঠির যে আবেদন ছিলো, তা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে।  পুত্রের কাছে মায়ের একটা চিঠি কিংবা মায়ের কাছে পুত্রের একটা চিঠির কী আবেদন তা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা একটি ছেলে বা মেয়ের অনুভূতিতে কখনোই স্পর্শ করবে না।  যুগে যুগে ব্যবহারিক প্রয়োজনে গ্রন্থাগারের সংজ্ঞা বদলেছে; জ্ঞানচর্চা ও বিনোদনকে পৃথক ভাবার দিনও শেষ হয়ে গেছে। এই যুগ বদলের সাথে সাথে প্রথাগত গ্রন্থাগারের ধারণা ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে। ভেঙে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভ্যন্তরে তথ্যানুসন্ধানের যাবতীয় সুবিধার ধরন। প্রশ্ন উঠেছে, এমন এক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গ্রন্থাগারের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে, না কি যুগের চাহিদা মিটিয়ে তা টিকে থাকতে পারবে?আমাদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর ও সুস্থ ভাবে গড়ে তুলতে সবাইকে বইয়ের আশ্রয়ে ফিরতেই হবে। কারণ, বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই। তবেই জ্ঞানের বহুপ্রাচীন সংরক্ষণাগার (Repository) হিসেবে গ্রন্থাগারের বিকাশ ঘটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কয়েক হাজার বছরে যেমন বদলে গেছে বই বা গ্রন্থের সংজ্ঞা, আদল ও সংরক্ষণ কৌশল, তেমনি বদলে গেছে গ্রন্থাগারের স্বরূপ এবং ব্যবহার পদ্ধতিও। প্রাচীন আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক বা মিশরীয় সভ্যতায় প্যাপিরাস, মাটি বা পাথরে, কিংবা লোহা, তামা বা সোনার পাতে লিখে রাজ অনুজ্ঞা সংরক্ষণের রীতি থেকে আজকের ডিজিটাল যুগে গুগল ড্রাইভে তথ্য সংক্ষরণ ও বিতরণ (save and dissemination ), কিংবা চীনে কাগজ আবিষ্কার বা মুদ্রণ কৌশল আবিষ্কারের পর জ্ঞান-বিজ্ঞান সংরক্ষণে বই, খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন যুগ পর্যন্ত যে একক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা আবশ্যিক বিবেচিত হত তার নাম ছিল গ্রন্থাগার। রাজ দরবার, ধর্মালয় কিংবা বিদ্যায়তনিক গ্রন্থসম্ভার গুটি কয়েক মানুষের হাত থেকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসে গণ-গ্রন্থাগার অভিধায়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো তাকে জনগণের বিশ^বিদ্যালয় (People’s university) রূপে স্বীকৃতি দেয়। এটা অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলার মত৷ একসময় এই দুই ক্লাবের ফুটবলের সঙ্গেই পরিচিত ছিল কলকাতার মানুষ৷ আবেগও ছিল ভরপুর৷ কিন্তু টেলিভিশন যখন বিশ্ব ফুটবল চেনালো, রাজ্যের ক্লাব ফুটবলও তার রং হারালো৷পাঠক তাই আর এখন বইমেলায় গিয়ে বই কেনেন না৷ বই দেখেন কম, খান বেশি, আড্ডা মারেন আরও বেশি৷বই সম্পাদনার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, “ভারতীয় বাজারের সঙ্গে তুলনায় বাংলা বইয়ের অধিকাংশ সম্পাদকরা এতই কম পারিশ্রমিক পান যে, তাদের কাছ থেকে ভালো কাজ আশা করা বৃথা৷ তাছাড়া বাংলা বইয়ের জগতে সম্পাদক বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে ধারণাটাই তৈরি হয়নি৷”অন্য এক প্রসঙ্গে আনন্দ পাবলিশার্সের সম্পাদক সুবীর মিত্র বলেছিলেন, “বই বিপণনের নানা পদ্ধতি আছে৷ বই পাড়ায় আনন্দই প্রথম টেলিফোনে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে৷ তা ছাড়া শহরের দুই প্রান্তে আমাদের নিজস্ব শোরুমও আছে৷ এখন আমরা নানা জায়গায় আরও শোরুম খুলছি৷”মুশকিল হলে, আনন্দ বা দে’জ পাবলিশিংয়ের মতো বড় মাপের প্রকাশনা সংস্থা কলকাতায় নেহাতই কম, যারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বই বিক্রির কৌশল রপ্ত করে নিয়েছেন।সুবীর মিত্ররা বুঝে গেছেন, পাঠক এখন আর বছরের একটি সময় বই কেনার জন্য হা-হুতাশ করে বসে থাকেন না৷ বই কেনা কিংবা অনলাইনে বই পড়ার আধুনিক পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি রপ্ত করে ফেলেছে৷ ফলে সে অনুযায়ী বিপণন প্রক্রিয়াও তারা শুরু করেছেন৷যারা পারেননি, বইমেলায় অনেক নতুন বই নিয়ে এসেও তারা নতুন প্রজন্মের কাছে সেই বই বিক্রি করে উঠতে পারছেন না৷এত কিছুর পরও বইমেলা আছে বইমেলাতেই৷ কথায় বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ৷ যতদিন যাচ্ছে, বাঙালির পার্বণের সংখ্যা ততই বাড়ছে৷ বইমেলা তার অন্যতম৷

 

 

Related Articles

Back to top button