মতামত

মা সারদা সবার অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা দেবী।

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

মানুষের মনের মধ্যে ধ্যান ধারণা, ভক্তি-শ্রদ্ধা আর আধ্যাত্বিক অনুভূতি যদি জন্ম নেয়, তাহলে ঈশ্বর প্রার্থী হতে পারেন তিনি। সেই জন্যেই চেতনার সৃষ্টি আর অনুভূতির উপলব্ধি মধ্যে জন্ম জ্ঞানচক্ষু,আর সেই জ্ঞানচক্ষু দিয়েই স্বয়ং ঈশ্বর কে দেখতে পাবে এযুগের মানুষেরা।স্বর্গ , নরক ও মর্ত্য তো সবই ত্রিভুবন ধরাধামে অবস্থিত।তাই মানবজাতির পাপ-পুণ্যের বিচার হবে মৃত্যুর আগেই।এই কথাগুলি লিখতে বসে আমার জীবনের ছোটবেলার স্মৃতি গুলো বার বার মনে পড়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছায় যা চেয়েছি ভগবান তা আমাকে দিয়ে করাইনি, তার যে কাজটি করানো সে কাজটি ঠিক আমাকে দিয়ে বারবার করিয়ে নিয়েছে।আমার গুরুজনেরা যেসব ধর্ম স্থানে আজও যেতে পারিনি, সেই সব ধর্ম স্থানে আমি বহুবার ঘুরে এসেছি স্বয়ং ভগবান আমাকে টেনে নিয়ে গেছে।আমার কাছে এ কোন অর্থ নেই অথচ এমন একটি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে আমি সেখানে হাজির হয়েছি।খুব ছোটবেলায় আমাকে দক্ষিণেশ্বরে বারবার টেনে নিয়ে গেছে স্বয়ং মা ভবতারিণী।যা আমি চাইনি তাই আমি পেয়েছি, যা চেয়েছি তা আমি আজও পাইনি। এ কথাগুলো একদম চিরন্তন সত্য আমার এই বয়সেও, হঠাৎ একটি যোগ হলো আমার বাড়ির সামনে থেকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে চলে গেলেন তারাপীঠ মন্দিরে।তারাপীঠ মন্দির এত ছোটবেলায় আমি দেখতে পাবো সেটা স্বপ্নে ভাবতে পারিনি, কেনো জানেন আমার গুরুজনেরা কর্মব্যস্ততা থাকতেন এবং মানব সেবা করতে তারা ব্যাড ব্যস্ত থাকতেন।আমার সঙ্গে সময় দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাদের সে সময় কোনদিন হয়ে ওঠেনি। ঈশ্বর যা চেয়েছেন তাই তো হয়েছে, আমার জীবনে। মায়ের মহিমা আজও আমাকে ভাবিয়ে তোলে, তারাপীঠ মন্দিরের শশান ঘাটে বসে ছিলাম । আচমকা লাল পাড়ের সাদা কাপর পরা এক বৃদ্ধ আমার সামনে হাজির। আমার কাছে খাবার আকুতি জানিয়েছে, খাওয়া দেওয়ার মতন সামর্থ্য আমার কাছে ছিল না সেই মুহূর্তে। সেকেন্ডের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই বৃদ্ধা।কয়েক মিনিট পরে, আমি সাড়া শ্মশান ও তারাপীঠ চত্বরে ওই বৃদ্ধাকে খুঁজে বেড়ালাম, কিন্তু তারা দেখতে পেলাম না। যে যন্ত্রনা আজও আমাকে কুরে কুরে খায়। মায়ের সেই মহিমা, আজ কারোর নয় অজানা।মায়ের মহিমা প্রচার ও অনুসন্ধান করে পথ চলা আমার জীবনের শুরু। মায়ের কোন বিকল্প শক্তি হতে পারে না এই ধরাধামে বুকে, মা অনন্ত কাল ধরে বিশ্বের জননী । তিনি ত্রিভুবনের জাগ্রত মাতৃশক্তি, সকলের জন্মদাত্রী তিনি। যুগে যুগে অবতার যিনি জগৎজননী মা সারদা৷ কখনও তিনি দেবী সরস্বতী বা কখনও মা লক্ষ্মী দেবী রূপে আবির্ভূতা। মা সারদা সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী৷ মায়ের কৃপায় পাহাড় সমান বাধাকে দূরীভূত করা যায়৷ মায়ের কৃপায় সংসারে অভাব দূর হয়ে থাকে৷ মা সারদা আবার অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা৷ যেখানেই মায়ের পায়ের ধুলো পড়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে এক একটি তীর্থ ক্ষেত্র। সেই জায়গা গুলো হল জয়রামবাটি, কামারপুকুর, দক্ষিণেশ্বর, বাগবাজার, সিমলা স্ট্রিট। এক কথায় যেখানে যেখানে পায়ের পায়ের ধুলো পড়েছে সেখানে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি তীর্থক্ষেত্র। মা আবির্ভূত হয়েছিলেন,১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলা ১২৬০ সনের ৮ পৌষ, অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদা মা রূপে। তাঁর পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সারদা দেবীর পিতৃকূল মুখোপাধ্যায় বংশ পুরুষানুক্রমে ভগবান শ্রীরামের উপাসক ছিলেন। সারদা দেবী ছিলেন তাঁদের জ্যেষ্ঠা কন্যা তথা প্রথম সন্তান। জন্মের পর প্রথমে সারদা দেবীর নাম রাখা হয়েছিল “ক্ষেমঙ্করী”। পরে “ক্ষেমঙ্করী” নামটি পালটে “সারদামণি” রাখা হয়। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কৃষিকাজ ও পুরোহিতবৃত্তি করে জীবিকানির্বাহ করতেন এবং তিন ভাইকে প্রতিপালন করতেন। দরিদ্র হলেও রামচন্দ্র ছিলেন পরোপকারী ও দানশীল ব্যক্তি। কথিত আছে, সারদা দেবীর জন্মের আগে রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী উভয়েই অনেক দিব্যদর্শন করেছিলেন। সারদা মায়ের জন্মের পর রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরীর কাদম্বিনী নামে এক কন্যা এবং প্রসন্নকুমার, উমেশচন্দ্র, কালীকুমার, বরদাপ্রসাদ ও অভয়চরণ নামে পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়।বাল্যকালে সাধারণ গ্রামবাসী বাঙালি মেয়েদের মতো সারদা দেবীর জীবনও ছিল অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে। ঘরের সাধারণ কাজকর্মের পাশাপাশি ছেলেবেলায় তিনি তাঁর ভাইদের দেখাশোনা করতেন, জলে নেমে পোষা গোরুদের আহারের জন্য ঘাস কাটতেন, ধানখেতে ক্ষেতমজুরদের জন্য মুড়ি নিয়ে যেতেন, প্রয়োজনে ধান কুড়ানোর কাজও করেছেন। সারদাদেবীর প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষা একেবারেই ছিল না। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন। তখন তাঁর কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে ভাল করে লেখাপড়া করা শেখেন। ছেলেবেলায় গ্রামে আয়োজিত যাত্রা ও কথকতার আসর থেকেও অনেক পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক শিখেছিলেন। ছেলেবেলায় পুতুলখেলার সময় লক্ষ্মী ও কালীর মূর্তি গড়ে খেলাচ্ছলে পূজা করতেন। সেই সময় থেকেই তাঁর বিবিধ দিব্যদর্শনের অভিজ্ঞতা হত। স্বয়ং ভগবান যে তার কপালে ঈশ্বর রূপ রেখা রেখে গেছে, সে কারণেই,তিন বছরের বালিকা সারদার সঙ্গে এক গানের আসরে প্রথম দেখা রামকৃষ্ণের। নবীন গায়ক দলের দিকে সারদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও’। বালিকা তার ছোট্ট তর্জনী অন্য দিকে রামকৃষ্ণের দিকে নির্দেশ করে বলল— একে। এরপর পাঁচ বছরের বালিকা সারদার বিবাহ হল চব্বিশ বছরের যুবক রামকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীর  মন্দিরের পূজারি।চেতনানন্দ বুঝিয়ে বলছেন, এ ধরনের বাল্যবিবাহ সেকালে প্রচলিত ছিল। তবে, একে বলা উচিত বাগ্‌দান। কারণ, কন্যা দেহে-মনে সাবালিকা হওয়ার পরই তাকে শ্বশুরগৃহে পাঠানো হত। কিন্তু ঠাকুর ও শ্রীমায়ের বিবাহ এক আধ্যাত্মিক বন্ধন। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে তিনি মহাসমাধী লাভ করেন পশ্চিমবাংলার কলকাতার বাগবাজার মায়ের বাড়িতে।মা জে আজো আমাদের ছেড়ে যাননি ,আমাদের মধ্যে রয়ে গেছেন তিনি। সেই কারণেই বরানগর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রমে দুর্গারূপে পূজিতা হন মা সারদা। হাওড়ার আমতার খড়িয়পে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ প্রেমবিহারেও মা দুর্গার সঙ্গে আরাধ্যা স্বামী বিবেকানন্দের ‘জ্যান্ত দুর্গা’ মা সারদাও। সেই ১৯৪৪ সাল থেকে মা সারদার প্রতিকৃতিকে দুর্গারূপে পুজো হয়ে আসছে বরানগর আশ্রমে। আর খড়িয়পে প্রেমবিহার প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থাৎ বিগত ১৯ বছর ধরেই এই রীতি চলে আসছে।বরানগরে চারদিন চার রূপে পুজো করা হয় মা সারদাকে। মা সারদাকে দুর্গারূপে পুজো শুরু হওয়ার পর বিসর্জন রীতি উঠে গিয়েছে আশ্রমে। বরানগরে মহাসপ্তমীর দিন সারদা মায়ের রাজরাজেশ্বরী বেশ। মাথায় থাকে সোনার কিরীট, বেনারসী ও আভরণে সুসজ্জিতা মা। অষ্টমীতে যেগিনী বেশী সারদা মা যেন তপস্বিনী উমা। গৈরিকবসনা, শিবস্বরূপা জটাজুটসমাযুক্তা তাঁর রূপ।আর নবমীর দিন তিনি কন্যারূপে আবির্ভূতা। এইদিনই কুমারী রূপে তাঁর পুজো করা হয়। দশমীতে মায়ের ষোড়শী বেশ। মা দুর্গা এদিনই পাড়ি দেন কৈলাসে। চারদিন বৈচিত্রের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় এই অভিনব পুজো। প্রতিমার বিসর্জন হয় না। এই আশ্রমে শুধু ঘট বিসর্জনই রীতি। এইসব রীতি-রেওয়াজ মধ্যেই মা সারদা হলেন ব্রহ্মবিদ্যা-র আঁধারস্বরূপ। তাঁর মাধ্যমে রামকৃষ্ণ তত্ত্ব অবগত হওয়া যায়। দক্ষিণেশ্বরে মা ঠাকুরের পদসেবা করার সময় বিনীত প্রশ্ন পেশ করেছেন, ‘আমাকে কি বলে মনে মনে হয়।’ শ্রীশ্রী ঠাকুরের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যে মা মন্দিরে আছেন এভং ভবতারিনী নামে আমার পূজা গ্রহণ করছেন- তিনিই এখন শ্রীমা সারদা হয়ে আমার পদসেবা করছেন।’ শ্রীমা সারদা ঈশ্বরী। গা্যত্রী জননী। তিনি ছিলেন অগ্নি ন্যায় তেজদৃপ্ত। তৎকালীন সময় দেশব্যাপী ইংরেজ হটাও আন্দোলন। মা কিন্তু আমার মাতৃভূমি এমন ভাবাবেগে আপ্লুত হননি বা প্রশ্রয় দেননি। অথচ নিজস্ব যুক্তি ও চিন্তায় স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নিজেও প্রত্যয়ী থেকেছেন। যেমন উদাহরণস্বরূপ উল্ল্যেখ করা যায় ইংরেজ সরকার প্রতিমুহূর্তে মায়ের বাড়ির প্রতি কড়া নজর রেখেছিল, যদিও সাহসে কুলোয়নি মা-কে ঘাটানোর। ‘শ্রীশ্রীমা’-র কাছে কোন কিছু অজ্ঞাত ছিল না, তবে অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী ‘মা’ দৃঢ় অথচ শান্তি আচার আচরণে রাজশক্তিকে উপেক্ষা করে গেছেন, তাঁর স্নেহের ছত্র ছায়ায় বহু বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছেন। নীরবে-নিভৃতে কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছেন। স্বামীজী শিবানন্দজীকে চিঠিতে লিখলেন, ‘যার মা-র ওপর ভক্তি নেই তার ঘোড়ার ডিম হবে। সোজা বাংলা কথা। ঠাকুর বরং যাক। ঠাকুরের থেকে মা বড়ো দয়াল। মা-কে তোমরা বোঝনি। মায়ের কৃপা লক্ষগুণ বড়ো।’তাই মায়ের বিকল্প আর কোনো বড় শক্তি হতে পারে না এ যুগেও।মায়ের অন্তর শক্তির ঊর্ধ্বে আজও আমরা যেতে পারিনি কেউ, মায়ের চেতনার সেইরূপ।
রামচন্দ্র প্রশ্ন করেন-‘কেগো তুমি’; বালিকার উত্তর: এই আমি তোমার কাছে এলুম। যারা পূর্ব পূর্ব অবতারদের লীলা সঙ্গিনী রূপে এসেছিলেন, যদি ঐতিহাসিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করি তাহলে অধ্যাত্মিক অভ্যুত্থানের জন্যে তাদের অবদানের স্বল্পতা দেখে বিস্মিত হই। কিন্তু শ্রীশ্রী মা যে ভাবে ঠাকুরের ভারধারাকে চারিদিকে প্রসারিত করতে সমর্থ হয়েছেন তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। ঠাকুর নিজেও মাকে শরীর ত্যাগের আগে বলেছিলেন: “এ (শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে) আর কি করেছে তোমাকে এর অনেক বেশি করতে হবে”। সেই অনেক বেশি কাজ শ্রীমা করেছেন তাঁর মৃতু ¯েœহের মাধ্যমে। ঠাকুরের সন্তানরা মাকে ঠাকুর থেকে পৃথকরুপে দেখতেন না। ঠাকুরেরই মাতৃরুপে আর একটি অভিব্যক্তি দেখতেন। শ্রীশ্রীমা নিজেও বলেছেন: “ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্যে আমাকে এবার রেখে গেছেন।” তবেই সারদাদেবী সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন: ‘ও সারদা-স্বরস্বতী-জ্ঞান দিতে এসছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যান হয়। তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে’। ও (সারদা) জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধি মতী। তেলোভেলোর মাঠে এক দস্যুদম্পতি সারদাদেবীকে কালীরুপে দেখেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুস্পপুত্র শ্রীমায়ের স্বমুখেই শুনেছিলেন যে, শ্রী শ্রী মা স্বয়ং মা-কালী, জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়িতে একটি বিড়াল ছিল। ব্রহ্মচারীগন তখন মায়ের সেবক। তিনি বিড়ালটিকে আদর যত্ন তো করতেনই না, বরং মাঝে মাঝে একটু-আধটু প্রহারাদিই করতেন। মাতা জানতেন, রাধু ও শ্রীশ্রীমায়ের ¯েœহে বিড়ালের বংশবৃদ্ধি হয়েছিল। একবার কলকাতা আসার সময় ব্রহ্মচারীকগণকে ডেকে মা বললেন: জান বেড়াল গুলোর জন্য চাল নেবে। যেন কারও বাড়ি না যায় গাল দেবে, বাবা। তারপর ভাবলেন শুধু এই টুকু বলাই বেড়ালের জগৎ ফিরবেনা। তাই আবার বললেন: দেখ জান বেড়ালগুলোকে মেরোনা। ওদের ভেতরেও তো আমি আছি “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেন সংস্থিতী” তিনিই যে আমাদের শ্রীশ্রীমা হয়ে এসেছেন নিজ মাতৃভাবকে অবলম্বন করে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। মা স্বমুখে বলেছেন: আমার শরৎ যেমন ছেলে, এই আমজাদ ও তেমন ছেলে। শরৎ স্বামী সারদানন্দ হলেন রামকৃষ্ণ মিশনের কর্ণধার, সম্পাদক, আর আমজাদ একজন ডাকাত। মা বলেছেন-“আমি সতের ও মা, অসতের ও মা”। মা যে বাস্তববাদী ছিলেন আর সে কারণেই স্বামী বীরেশ্বরানন্দ ‘শ্রীশ্রীমা’ সম্পর্কে লিখছেন-একবার দুজন যুবক এল। দুজনেই রাজদ্রোহী। মা তাদের স্নান করতে পাঠালেন, তারা স্নান করে এলে তাদের দীক্ষা দিলেন। তারপর তাদের খাইয়ে দাইয়ে তাড়াতাড়ি অন্যত্র যেতে বললেন। এসব ছেলেদেরও দীক্ষা দিতে মা এতটুকু ভয় পেতেন না। মা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দীক্ষা দিয়ে গেছেন। মা যখন উদ্বোধনে অত্যন্ত অসুস্থ তখন একদিন এক পারসী যুবক এসে উপস্থিত। তিনি মঠে অতিথি হয়ে কয়েকদিন ধরে বাস করছিলেন। এখন মায়ের কাছে এসেছেন তাঁকে দর্শন করতে এবং তাঁর কাছে দীক্ষা দিতে নিতে। মায়ের তখন এত অসুখ যে দর্শন একেবারে বন্ধ। এই যুবক নিচে বসে রইলেন। তাঁকে দোতলায় যেতে দেওয়া হল না। মা কিন্তু কিভাবে জেনে গেলেন যে, এই যুবকটি নিচে তাঁর দর্শনের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি তখন একজনকে বললেন তাকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে আসতে। মা তাকে দীক্ষা দিয়ে নিচে পাঠালেন। স্বামী সারদানন্দ এই ঘটনার কথা জানতে পেরে মন্তব্য করলেনঃ ‘মায়ের যদি এক পারসী শিষ্য করার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলে আমার আর কি বলার আছে?’ এই পারসী যুবকটি আর কেউ না, চিত্র জগতের বিখ্যাত অভিনেতা ও প্রযোজক বম্বের সোরাব মোদি। সেইজন্যে বিবেকানন্দের মতো ঠাকুর-অন্ত প্রাণ ভক্ত বার বার বলেছেন, মায়ের স্থান ঠাকুরেরও উপরে। হঠাৎ একটু খটকা লাগতে পারে। রামকৃষ্ণের আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচার করার ভার যে বিবেকানন্দের উপর ঠাকুর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর মুখে এ কী কথা? কিন্তু বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছেন, মায়ের মাধ্যমে ঠাকুর স্বয়ং নির্দেশ দিচ্ছেন। বিবেকানন্দ তাই গুরুভাইদের ডেকে ডেকে বলছেন, ওরে, তোরা এখনও মাকে চিনলি না।বিবেকানন্দ বিশ্বজয় করে ফিরে এলেন দেশে। পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নে তাঁর বক্তৃতা সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলল। ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে তাঁর একটি সুন্দর সাক্ষাৎকারের বিবরণ আছে। স্বামীজি সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন মায়ের পায়ে। কত দিন পরে তাঁকে দেখে মায়ের চোখে পুত্রস্নেহ। উপস্থিত সকলে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ উপলব্ধি করলেন।পাশ্চাত্যের রমণীদের সঙ্গে মায়ের সখ্যের উপর আছে কৌতূহলজনক আলোচনা। গ্রামের মেয়ে সারদা, এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। কিন্তু চমৎকার আলাপচারিতা চালিয়ে যান সারা বুল, মিস ম্যাকলয়েড বা সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু আহার করেন এঁদের সকলের সঙ্গে। সিস্টার নিবেদিতা বলেন, মা, তুমি আমাদের কালী। মা বলেন, না না, তবে তো আমাকে জিভ বার করে রাখতে হবে। নিবেদিতা বলেন, তার কোনও দরকার নেই। তবু তুমি আমাদের কালী, আর ঠাকুর হলেন স্বয়ং শিব। মা মেনে নেন। নিজ হাতে রঙিন উলের ঝালর দেওয়া হাতপাখা বানিয়ে দেন নিবেদিতাকে। নিবেদিতার সে কী আনন্দ এমন উপহার পেয়ে, সকলের মাথায় হাতপাখা ছোঁয়াতে থাকেন। মা বলেন, মেয়েটা বড় সরল। আর বিবেকানন্দের প্রতি আনুগত্য দেখবার মতো। নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে গুরুর দেশের কাজে লাগবে বলে। নিবেদিতার ভারতপ্রেম অতুলনীয়। এসব ছিল মায়ের মহিমা। মা ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা দের পরাস্ত করেছিলেন।ব্রিটিশ গোয়েন্দাপ্রধান চার্লস অগস্টাস টেগার্ট-এর রিপোর্টের (১৯১৪) ভিত্তিতে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বিপ্লবীদের সাহায্য করা এবং আশ্রয় প্রদানের অভিযোগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য ১৯১৬-র ১১ ডিসেম্বর বিশেষ বৈঠক ডেকেছিলেন। সে-খবর পেয়েই শ্রীমা চটজলদি মঠের তৎকালীন সম্পাদক সারদানন্দ এবং জোসেফিন ম্যাকলাউডকে পাঠালেন কারমাইকেলের কাছে। মা বুঝিয়ে বলতে বলেন যে, বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তা ব্রিটিশ সরকারেরই বিড়ম্বনা বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত কারমাইকেলের হস্তক্ষেপে ব্রিটিশ সরকার বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা থেকে বিরত হয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বিশেষ নজর ছিল বেলুড় মঠ, উদ্বোধন, জয়রামবাটী, কোয়ালপাড়া ইত্যাদি স্থানের উপরে। সেই সময়ে অনেক বিপ্লবী মায়ের অনুমতি নিয়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তরুণ বিপ্লবীদের জন্য তাঁর ভালবাসার অভাব ছিল না।স্বামী প্রেমানন্দ একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘শ্রীমার আদেশ পালনই আমাদের ধর্ম, কর্ম। আমরা যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। যাকে যা বলবেন, সে তাই করতে বাধ্য।’ প্রেমানন্দের শ্রীমা সারদা সম্পর্কিত অভিমত এই যে, রাজরাজেশ্বরী মা শাক বুনে খাচ্ছেন, ভক্তের এঁটো কুড়োচ্ছেন, কাঙালিনী সেজে ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে পরছেন। 

Related Articles

Back to top button