কলকাতা

দিব্যভূমি বিশ্ব সেবাশ্রম সঙ্ঘ,প্রতিষ্ঠাতা মাতৃসাধক আনন্দময় দিব্যপুরুষ শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারী।

শাস্ত্র বলে ঈশ্বর দর্শনলাভে সিদ্ধকাম মহাত্ম্যাগণ যে স্থানে থাকেন সেখানেই ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ উপস্থিত হয়৷ ফলে সাধারণ মানুষ সেখানে উপস্থিত হলে অতি সহজেই ঈশ্বরের ওই প্রকাশভাবকে কিছু না কিছু উপলব্ধি করেন৷ কলকাতার অদূরে বিমানবন্দরের পাশে এমনই এক দিব্যভূমি বিশ্ব সেবাশ্রম সঙ্ঘ৷

যেখানে রুদ্রাক্ষবৃক্ষ শোভিত, সারা পৃথিবীর ১৫১টির অধিক পবিত্র তীর্থের জলে পরিপূর্ণ ব্রহ্মসরোবরে পারে বিদ্যমান এক দিব্য মন্দির স্থানীয় লোকজন এবং দেশ বিদেশ থেকে আগত ভক্তবৃন্দও বলেন বিশ্ব মানবতার শান্তির নীড় ‘বিশ্বমাতা মন্দির৷’ হ্যাঁ বিশ্ব সেবাশ্রম সঙ্ঘ এবং সঙ্ঘের জমিতে বিরাজমান মা কালীর বিশ্বমাতা মন্দির সত্যিই শান্তির নীড়৷ আপনি যতই অশান্ত মনে এখানে আসুন না কেন বিশ্ব সেবাশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে যেই ঢুকবেন দেখবেন সারা পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা যেন আপনার মাথা থেকে সরে গেছে৷ আপনার মন যেন অনেক হালকা হয়ে গেছে৷ এটা এখানে আগত ভক্তবৃন্দের অনুভূতি ও এই লেখকের অভিজ্ঞতার প্রকাশ৷ যাতে কোনও অতিশায়ক্তি নেই৷ আর আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মাতৃসাধক আনন্দময় দিব্যপুরুষ শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করলে আপনার একথা তো মনে হবেই এই জায়গা আপনার নিজের৷ উনি যেন আপনার কত আপনজন৷ এতদিন কেন আপনি আসেননি এই পুণ্যভূমিতে বিশ্বমাতা দক্ষিণাকালী এবং মাতৃসাধক শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করতে৷ মায়ের মন্দিরের সঙ্গে আশ্রম প্রাঙ্গণে আছে একাধিক মন্দির৷ শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির এবং নর্মদেশ্বর বাণলিঙ্গের মন্দির৷

মায়ের মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে আপনি যখন বিশ্বমাতা দক্ষিণা কালীকে দর্শন করবেন—দেখবেন মা যেন ঠিক ছোট্ট চপলমতি বালিকা৷ আপনার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছেন৷ মনে হবে যেন আপনার নিজের সুন্দরী লক্ষ্মী পয়মন্ত মেয়ে৷ ভারী আপনজন মনে হবে বিশ্বমাতাকে দেখলে৷ কষ্টি পাথরের অপরূপ মূর্তি৷ শ্বেতমর্মর প্রস্তরাবৃত তিনটি সোপানযুক্ত উচ্চবেদী৷ বেদীর ওপর প্রস্তর নির্মিত সহস্রদল পদ্ম৷ তার উপর মহাকালরূপী শিব শব হয়ে পশ্চিম দিকে মাথা, পূর্বে পা দিয়ে শুয়ে আছেন৷ শিবের অবয়ব শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত৷ তাঁর বুকের পর ডান পা বাড়িয়ে বারাণসী চেলি পরিহিতা পুস্পসজ্জায় সজ্জিত সুন্দরী ত্রিনয়নী দক্ষিণাকালী সলাজ তরুণীর ন্যায় জীব কেটে দাঁড়িয়ে আছেন৷ বিশ্বের পালনকর্ত্রী মা, রাজ-রাজেশ্বরী তিনি৷ তাই শ্রীসমীরেশ্বর তাঁতে ডাকেন বিশ্বমাতা নামে৷ বেদীর সামনে সিঁদুররঞ্জিত আম্রপল্লব ও পুষ্পমাল্যে শোভিত মঙ্গলঘট৷ প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই এই ঘটে সাপের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করেছেন৷ আর রয়েছেন নিত্য পূজিতা পাথরের জগদ্ধাত্রী, সুবিশাল ২২ কেজি ওজনের শালিগ্রাম (নারায়ণ) শিলা৷ নয়নাভিরাম বিশ্বমাতার কাঠের সিংহাসনের দুই পাশের দেওয়ালে বিশ্বমাতা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মাতৃসাধক শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারীর পিতা গিরিন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এবং মাতা আশালতাদেবীর তৈল চিত্র বিরাজমান৷ এই দুটি ছবি শ্রীসমীরেশ্বর অঙ্কন করেছেন৷ কারণ তিনি অসাধরণ একজন চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতকার, ভাস্কর, মৃৎশিল্পী, সুগায়ক৷ বর্তমান মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্নানযাত্রার শুভদিনে ২৪ শে জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৭ সন)৷ তার পূর্বে মন্দির ছিল টালির চাল এবং দরমার বেড়ার৷

যাঁর দিব্য সাধনা এবং প্রভাবে শ্রীশ্রী বিশ্বমাতা দক্ষিণাকালী এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন সেই প্রণম্য দিব্যপুরুষ শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারী অতি শৈশবেই নিজের হাতে মাতৃমূর্তি তৈরি করে পূজা করতেন৷ পাড়া প্রতিবেশী এবং আশ্রমের প্রবীণদের কাছে জানা গেল তখন তিনি অতি শিশু, বয়স হবে ৪ কী ৫ বছর৷ অতটুকু শিশু নিজের হাতে মায়ের মূর্তি গড়ছেন এবং পূজা দিচ্ছেন আবার অনেকেরই ভূত ভবিষ্যত হঠাৎ হঠাৎ বলে দিচ্ছেন দেখে আসপাশের প্রতিবেশীদের ভীড় হতে থাকলো৷ সেই ভীড় এবং শিশু শ্রীসমীরেশ্বরের দিব্যপ্রভাবও দিনে দিনে বৃদ্ধি হতে থাকলো৷ তখন তাঁর দাদা টালির চাল দরমার বেড়ার মন্দির তৈরি করে দিলেন৷ মায়ের এখানে নিত্য অন্ন ভোগ হয়৷ মা পূজীতা হন বৈষদ্ধবীরূপে তাই কোন আমিষ ভোগ হয় না৷ পশু বলিদানও হয় না৷ দুই বেলা নিত্যপূজার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি অমাবস্যার সন্ধ্যায় ষোড়শপচারে বিশেষ পূজা হয়৷ ওই দিন চালকুমড়ো, আখ, আদা, কলা বলি দেওয়া হয়৷ এছাড়াও প্রতি বছর স্নানযাত্রার পূর্ণিমার দিনে মায়ের সারারাতব্যাপী বিশেষ পূজা সম্পন্ন হয়৷ মাকে দীপান্বিতা কালীপূজায় স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করা হয়৷ বাকি সময় কিছু স্বর্ণালঙ্কার পরিহিতা থাকলেও পুষ্পসজ্জাতেই সজ্জিত করা হয়৷ বেনারসী শাড়ি প্রতি অমাবস্যায় পরিবর্তন করা হয় এবং মায়ের প্রসাদী বেনারসী গরীব দুঃস্থ মেয়ের বিয়েতে উপহার দেওয়া হয়৷ প্রতি অমাবস্যায় খুিচুড়ি, পঞ্চ ব্যাঞ্জন, পঞ্চ ভাজা, চাটনি, পরমান্ন ছাড়াও মরশুমি ফল প্রদান করা হয়৷ মায়ের মূল ভোগের মিষ্টি গরুর দুধ দিয়েই তৈরি হয়৷ অমাবস্যার পূজা শুরু হয় সন্ধ্যায়৷ ভক্তরা পূজা দর্শন করে মাতৃপ্রসাদ দিয়ে রাত ৯টার মধ্যেই বাড়ির দিকে যাত্রা করতে পারেন৷ দীপান্বিতা কালীপূজার পর অন্নকূট উৎসব হয়৷ এইখানে বিশেষত্ব এই যে মাতৃসাধক শ্রীসমীরেশ্বর নিজের হাতেই অন্ন দিয়ে অপরূপ মা অন্নপূর্ণার মূতি নির্মাণ করে শাড়ি গহণা পড়িয়ে পূজা করেন৷ দেখ মনে হবে যে প্রস্তরের মাতৃপ্রতিমা পূজা গ্রহণ করছেন৷

মন্দির বা আশ্রম খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং অপরাহ্ণ ৪ টা থেকে রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত৷ তবে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবে সারাদিনই ভক্তদের অবাধ প্রবেশ৷ বর্তমান বিশ্বমাতা মন্দিরের পাশেই আছে শ্রীসমীরেশ্বরের সাধনার পঞ্চমুণ্ডি আসন৷ যেখানে তিনি সিদ্ধি লাভ করেছিলেন৷ মন্দিরের সামনে তৈরি হচ্ছে রাজস্থানের বংশীপাহারপুরের বালু পাথর দিয়ে সুবৃহৎ সম্পূর্ণ পাথরের নতুন মন্দির৷ এই মন্দির নির্মাণের সময় কোনওরূপ লোহা, স্টিল, পিতল ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে না৷ কেবল নয়নাভিরাম কারুকার্যময় ভাস্কর্যে খোদিত পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে মন্দিরটি তৈরি হচ্ছে৷ মন্দিরের দৈর্ঘ্য ৭২ ফুট, প্রস্থ ৪৮ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট হবে৷ দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার দেবমন্দির নির্মাণের স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের নির্দেশনা অনুসারে সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় রীতি এবং নীতি অনুযায়ী প্রাচীন লতিন নাগরশৈলী ঘরানার শাক্ত মন্দিরটি নির্মাণ হচ্ছে৷ প্রতিষ্ঠাতা মাতৃসাধক আনন্দময় দিব্যপুরুষ শ্রীসমীরেশ্বরের ইচ্ছা যে ত্রিতাপদগ্বূ মানুষ এই মন্দিরে এসে শান্তি লাভ করবেন৷ তাই তিনি বলেন—বিশ্ব মানবতার শান্তির নীড় বিশ্বমাতার নতুন মন্দির৷
এই পুণ্যভূমিতে বিরাজমান সাড়ে সাত ফুট উচ্চতার ৪টন ওজনের নর্মদেশ্বর বাণলিঙ্গ৷ যা নর্মদা নদীতেই একমাত্র প্রাপ্ত হয়৷ বিরাজমান এবং নিত্য পূজা পাচ্ছেন দ্বাদশ শিব লিঙ্গ৷ সেই সঙ্গে বিরাজমান কৈলাসেশ্বর মহাদেব৷ পূজ্য শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারী যখন কৈলাস মানস সরোবর গিয়েছিলেন তখন শিবধাম কৈলাস পর্বত থেকে শিবলিঙ্গ এনে আশ্রমে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভক্ত কল্যাণে৷ আশ্রমে পূজা গ্রহণ করছেন প্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা এবং সুদর্শনদেবের আদি চতুর্ধার মূর্তি৷ স্নানযাত্রার পুর্ণিমায় বিশ্ব সেবাশ্রম সঙ্ঘের সর্বতীর্থের জলে পরিপূর্ণ ব্রহ্ম সরোবরের তীরে প্রভু জগন্নাথের মহাস্নান সম্পন্ন হয়৷ দুপুরে প্রভুর গজবেশ হয়৷ স্নানযাত্রার আগের দিন থেকে স্নানযাত্রার সারাদিনরাত মন্দিরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসব পালিত হয়৷ রথযাত্রা সম্পন্ন মহাধূমধাম সহকারে৷ ৬ ফুট লম্বা রূপোর ঝাড়ু দিয়ে ৩০ ফুট সুউচ্চ রথযাত্রার সূচনা হয়৷ দুর্গাপূজার চারদিন মহাধূমধাম সহকারে দুর্গাদেবীর আরাধনার পাশাপাশি অষ্টমীকে ব্রাহ্মণ বালিকাকে কুমারী রূপে পূজা করা হয়৷ একমাত্র পর নবমীতে জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়৷ দুর্গাপূজা এবং জগদ্ধাত্রীপূজায় মাকে খিঁচুড়ি, পঞ্চ ব্যাঞ্জন, পঞ্চ ভাজা, চাটনি, পরমান্ন, নাড়ু, নানাবিধ মিষ্টি এবং ফলের সঙ্গে সঙ্গে তিন প্রকার মাছের ভোগ দেওয়া হয়৷ অগ্রহায়ণের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি প্রতিষ্ঠাতা শ্রীসমীরেশ্বরের আবির্ভাব তিথি উৎসব পালিত হয়৷ এই উপলক্ষে ১৫ পূর্ব থেকে সেবাপক্ষ পালন করা হয়৷ ইংরেজি বছরের প্রথম দিন প্রতিবছর অখণ্ড গীতা মহাযজ্ঞ করা হয়৷ সমস্ত ভক্তবৃন্দ ওই যজ্ঞে সামিল হতে পারেন৷ দেব আরাধানার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাসিক রেশন, সাংস্কৃতিক উৎসব, প্রকাশন, ত্রাণকার্য চলে সারা বছর ধরে৷ কারণ আত্মার মুক্তি ও মোক্ষের সঙ্গে সঙ্গে আর্ত মানবের সেবাই বিশ্ব সেবাশ্রম সঙ্ঘের ব্রত৷ আর আমি সেই ধর্মে বিশ্বাস করি যা মানুষকে বাঁচায়, গভীর ভক্তির দ্বারা সেবাই প্রকৃতি ধর্ম—এই শ্রীসমীরেশ্বর ব্রহ্মচারীর বাণী৷ কারণ তিনি বলেন করেন—বড় মানুষ হতে হবে বড় মানসিকতা তৈরি কর৷ ভাবই ঈশ্বর ঈশ্বরই ভাব৷ চেতনা আনো চৈতন্য হবে৷
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে কীভাবে যাবেন এই পুণ্যভূমিতে দেবদর্শন এবং দেবপুরুষ দর্শনে৷ পথটা তাহলে বুঝে নিন৷ যদি কলকাতা থেকে ট্রেনে আসেন তবে শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনের ট্রেনে চড়ে বিশরপাড়া-কোদালিয়া রেল স্টেশনে নেমে পূর্ব দিকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ৷ আর বাসে করে আসলে যশোহর রোড হয়ে এয়ারপোর্ট বা মধ্যমগ্রামগামী যে কোনও বাসে মাইকেলনগর স্টপেজে নেমে ১২-১৩ মিনিটের হাঁটা পথ বা রিস্কায় আশ্রমের গেট৷

Related Articles

Back to top button