গল্প ও কবিতা

স্বভাব যাবে না!

 

অশোক পাল

 

ক’দিন থেকেই ডানা ঝাপটানোর শব্দটা ফারুকের কানে বাজছিল। শত ব্যস্ততার মাঝে অত গুরুত্ব দেয়নি সে। এমনিতেই নিজের পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। লেখালেখি, প্রুফ দেখা আছেই। তার উপর কলকাতার একটি পত্রিকা হাউস তাদের পূজো সংখ্যার জন্য লেখার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। চাকরি, সমাজ সেবার সঙ্গে লেখালেখির নেশা দিনটাকে বড্ড ছোট করে দিচ্ছে ফারুকের।

আজকে ভেবেছিল সকাল সকাল পত্রিকার লেখাটা শেষ করবে। ঘরের জানালা খুলে দিলেই মনটা উদার হয়ে যায়। লেখার টেবিলে সােজাসুজি বাইরে একটা সাদুল্লা আমগাছ। গাছগাছালি পেরিয়ে একটু দূরেই নাটাপুকুর বাজার। এ বছর গাছটায় বোল আসেনি। তাই এই ফাগুনে গাছ ভৰ্ত্তি সবুজ আম্রপল্লবে ভরে উঠেছে। ডানা ঝাপটানোর শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। আজ রবিবার ছুটির দিন। মেয়ে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। ঘড়িতে আটটা বাজে। স্ত্রী সানিয়া রান্না ঘরে টুংটাং শব্দে চা তৈরিতে ব্যস্ত।পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দটা আজ ফারুক খানের মনে যেন অন্য অনুভূতি বয়ে আনছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখল দুটো ঘুঘু পাখি মৈথুনে মত্ত। গাছের ডালে বাসর সাজিয়ে নিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরেই সে ঘুঘু পাখি দুটোর ভালবাসার খেলা দেখছিল। চা- বলেই, সানিয়া টেবিলে এক কাপ চা আর খান কতক লিটল হার্ট বিস্কুট রেখে দিল। সানিয়া বলল— বাজার যাবে না? রবিবার এলেই খাসির মাংস হওয়া চাই। একটু পরে যাচ্ছি। বলেই ঘুঘুর দিকে নজর দেয়। কিন্তু ততক্ষণে পাখি দুটি আর নেই!

ঠিক যেমন তার জীবনেও প্রেম উড়ে গিয়েছিল। নিজেদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও নিজেকে শাহরুখ খানের মতো হিরো ভাবত মনে মনে। ঘরে অভাব থাকলেও গায়ের রং, চেহারা ছিল ভাঙা ঘরে রাজকুমার। সেই রাজকুমারের হৃদয়ে একদিন রাজকন্যা হয়ে দেখা দিল সে…। তখনও ফারুক জানত না তানিয়া নামের অর্থ কী? প্রথম দেখার দিনেই হৃদয়ের চিলেকোঠায় বসিয়েছিল সেই রাজকন্যাকে। শুধু সেই পরির মত রাজকন্যাকে এক গরিব রাজকুমার একটি বার দেখবে বলে ভাঙড় বালিকা বিদ্যালয়ে ভাগ্নিকে আনতে যাবার অছিলায় হাজির হতো প্রতিদিন। স্কুল ছুটির দিনগুলোয় যেন সময় কাটতে চাইতো না। তানিয়াকে একটিবার দেখার জন্য মন ছটফট করতো। বড়লোক বাড়ির রাজকন্যাকে গরিব রাজকুমার সাহস করে কখনো বলতে পারেনি তার মনের কথা। সে ভেবেছে একদিন পড়াশুনো শেষ করে চাকরি বাকরি করে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তখনই সে পরির মতো রাজকন্যাকে তার ভালবাসার কথা বলবে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! খুব ছোটবেলায় ফারুক খান তার পিতামাতাকে হারায়।
চারদিক আকাশ মেঘে ঢেকেছে। সহসা কালবৈশাখি আসবে মনে হচ্ছে। দ্রুত সাইকেল ছুটিয়ে যাচ্ছে ভাগ্নিকে আনতে স্কুল থেকে। কড় কড় কড়াৎ মেঘের গর্জন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিল। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। ফারুক সাইকেল চালিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলের গেটে পৌছল। কিন্তু একি? স্কুলে কেউতো নেই। মেঘ দেখে কি আগেই ছুটি হয়ে গেল…! তার ভাগ্নিকেও তো কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। আশেপাশে কেউ নেই। সব কি মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গেল নাকি…?
এদিকে আকাশ ভারী হয়ে আসছে। স্কুলের বারান্দায় সাইকেলটা রেখে পাগলের মতো এ ঘর ও ঘর ছুটতে লাগল। দরজা জানালা সব খোলা। কেউ নেই ক্লাসরুমে বাতাসের ঝাপটায় খটাশ খটাশ আওয়াজ হচ্ছে। ঘরে জল ঢুকে যাচ্ছে। এ বারে ঝড় শুরু হল। সঙ্গে বৃষ্টি। ক্লাস রুমের জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সবকটা ঘরের এক অবস্থা এ ঘর, ও ঘর দৌড় ঝাপ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে ফারুক।

এই বিকালেই আঁধার নেমে এসেছে জগৎ জুড়ে। স্কুল বাড়িটা যেন বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে। সেই আলোয় দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। সারা স্কুল বাড়িতে কেউ নেই। তবে কে… ওখানে…? হেড মাস্টারের রুমের সামনে বারান্দায় বসে আছে সেই ছায়ামূর্তি। স্কুল ড্রেস পরা। তাহলে কোনও ছাত্রী নিশ্চয়। একটু বুকে সাহস পায়। কিন্তু পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছে না কে বসে আছে। ধীরে পায়ে এগিয়ে যায় ফারুক। বৃষ্টিতে স্কুলের মাঠ জলে টইটম্বুর। সেই জলে হাঁটু ডুবিয়ে ভিজে একশা। তবু নির্বিকার সেই ছায়ামূর্তি। পেছন থেকে ডাক দেয় কে… ওখানে? নির্বিকার ভাবেই জবাব দেয় আমি তানিয়া…। একা একা জলে ভিজছ, শরীর খারাপ করবে…? উঠে এসো…? না, আমার ভিজতে ভাল লাগে। তুমিও এসো। দু’জনে ভিজবো। তানিয়ার আহ্বান ফেরাতে পারে না ফারুক। ওর পাশে গিয়ে বসে। তানিয়া মাধুরী দীক্ষিতের মত খিল খিল করে হেসে ওঠে।…
জব জবে ভিজে শরীরে তানিয়া ফারুককে জড়িয়ে ধরে। ফারুক যেন বিবশ হয়ে পড়ে। তারপর ঝুপ করে জলে ঝাপিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তানিয়া পাগলের মত চুমু খেতে থাকে। ভিতুর ডিম কোথাকার…? আমাকে এত ভালবাসাে মুখে বলতে পার না? ফারুকও সাহসী হয়ে ওঠে। শিরা উপশিরায় রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ভাল লাগার নায়িকাকে এত সহজে পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি। আলতো করে কপালে চুমু খায় তারপর গালে, ঠোটে গলায় থেকে বুকে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। এক ঝটকায় জামার বোতাম খুলে দেয়। উদ্ধত যৌবনের ডাকে বিলিয়ে দেয় নিজেকে তানিয়ার শরীরের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে। সে নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে করে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানায় মনে মনে।

মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে যায়। ধড় ফড়িয়ে উঠে পড়ে ফারুক। তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল?নবদিশা সংগঠনের কাজে আজ বহরমপুর যাবার কথা। হাজার দুয়ারি এক্সপ্রেস ধরতে হবে। কলকাতা, কল্যাণী থেকে আরো কয়েকজন যাবে। অনেক দিন পর তানিয়ার স্বপ্ন দেখে বেশ অবাক হয়। দ্রুত আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ে। ট্রেনে ভিড় তেমন নেই। কলকাতা স্টেশন থেকে জানালার পাশে একটি সিটে বসে সে। মইদুল, রহমান, সমীর তার সফরসঙ্গী। নবদিশার কলকাতায় কনফারেন্স যখন অনুষ্ঠিত হয় তখন বিখ্যাত পুলিশ অফিসার শামিম সাহেব হাজির থাকেন। যিনি আবার একাধারে বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও আদর্শ শিক্ষক। পড়াশুনোর পাশাপাশি জীবিকার সন্ধানে আরেক দক্ষ অফিসার ড. মনিরুল ইসলামের সহযোগিতা পান। ওনার উপন্যাস পড়ে খুব ভাল লেগেছিল। ডোমকলে মনিরুল ইসলামের বেসরকারি সোসাইটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেয়। পেছনে পড়ে রইল তানিয়া আর ভাঙড়। ডোমকল হয়ে উঠল বিচরণক্ষেত্র। মাঝে মধ্যেই ফারুক ফোন করে তানিয়াকে। সে জানায় চাকরি পেয়েছে, এবার সে তাকেই বিয়ে করবে। একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে সে তার বাড়িতে যায়। তানিয়ার পিতা সম্রান্ত পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফারুকের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে অস্বীকার করে। ফারুককে চরম অপমানও করে। সে তার ভালবাসার কাছে আজও নিজেকে যোগ্য করে তুলে ধরতে পারে নি। এই চিন্তায় সে ভেঙে পড়ে। হাজার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ নেয় এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারি চাকরি পেয়ে পরিবারকে দেখাবে।
বাড়ির ছেলে চাকরি-বাকরি পেলে বাবা-মায়ের সেই চিরন্তন আবদার। ঘরে বউ আনো। দু’চারটি মেয়ে দেখাও হয়েছে। তেমন পছন্দ হয়নি। তবে আমতলা পাটিকা বাড়ির সানিয়াকে সবার পছন্দ না হলেও মনিরুল ইসলামের বন্ধুর মেয়ে। তাকে ফেরানো যায়নি। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। যার চোখ দুটো দেখে পাগল হয়ে যেত। ওই গভীর চোখে ডুবে যেত ইচ্ছে করতো। এক দিন না দেখলে মনে হতো কত যুগ দেখা হয়নি। ভেবে রেখেছিল জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তানিয়াকে জীবনসঙ্গিনী করবে। কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল। মহাধুমধাম করে সানিয়ার সাথে বিয়ে হয়ে গেল…। বেশ কাটছিল জীবনতরী। মেয়ে রাইমা ও রিহান ওদের জীবন আলো করে রেখেছে।

বছর তিন হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগ দিল ফারুক। এতে আরো ব্যস্ততা বেড়েছে। বাংলা সাহিত্যের রথী মহারথীরা ফারুকের পত্রিকায় লিখছেন এবং প্রকাশ করছেন। নিজেও ডেলি নিউজের পাতার পরিচিত মুখ। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মহলে নিজের বিশেষ পরিচয় গড়ে উঠেছে। আজ ঘরে অভাব নেই। সমাজের ওপর তলার বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা। তবু কোথায় যেন মনের মধ্যে বিরাট শূন্যতা। এত পেয়েও যেন কিছুই হয়নি পাওয়া। বড় বিচিত্র বিধাতার সৃষ্টি এই মানুষ। আর তার থেকেও আরো বিচিত্র তার মন। যার কোনও তল খুঁজে পাওয়া যায় না। যে তানিয়ার জন্য একদিন পাগল ছিল। আজ তাকে পাওয়া হলো না। আসলে পুরুষ তার মনের মণিকোঠায় একজন প্রেমিকাকেই তুলে রাখে। সুখে-দুঃখে তার স্মৃতি জীবনভর আগলে রাখে। ওখানে আর কাউকে ঠাই দেয় না। আর বাকি সব অভিনয়।
নবদিশার সমাজসেবা করতে গিয়ে বহুদিন পর তানিয়ার সাথে দেখা হয় ফারুকের। তানিয়া এখন কলকাতার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। অবিবাহিতা। সময় সুযোগ পেলে নবদিশার অনুষ্ঠানে আসে। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে এখন নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তবু সামনে এলে বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে। হার্টবিট বেড়ে যায়। সেই চোখ এখন আরো ঘন, গভীর সুন্দর। তানিয়া সত্যি আজও সেই পরীর মতো রাজকন্যা হয়েই আছে। পিতামাতা ফারুকের হাতে তুলে দেয়নি। তানিয়া সে তার ভালবাসার কাছে হেরে যায়নি। পিতামাতার উপর অভিমান করে সে আজও বিয়ে করেনি। তার একটা আত্মসম্মান আছে। সে তার ভালবাসাকে আজও মর্যাদা দেয় এবং মনে মনে আজও সে ফারুককেই ভালবাসে। যদিও কাউকে তা বুঝতে দেয় না।
পাশে সানিয়া, রাইমা ও রেহান গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘুম নেই কেবল ফারুকের চোখে। মন অস্থির হয়ে উঠছে। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। চারদিক শুনশান। অদ্ভুত এক নিঝুম রাত নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। বিছানা থেকে উঠে পড়ে। জল খায়, চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে পড়ে। একটা নাম-না-জানা রাত পাখি উড়ে যায়। এই নিঃশব্দ, নীরব রাতের চারপাশে এক মায়াবি আলো খেলা করছে। আকাশে অর্ধগোলাকার চাঁদ! ফারুকের মনে দারুণ ঝড় এই নিশুতি রাতে! হোয়াটঅ্যাপে তানিয়াকে তার ভালবাসার কথা জানিয়ে ছিল। তানিয়া তখনও অনলাইনেই ছিল। ফারুকের বুকে তখন সুবাসিত ঝড়, অনন্তকালের অপেক্ষা যেন। এক দুই তিন থেকে পাঁচ মিনিটের অপেক্ষাও যেন তর সইছে না। বারান্দায় অস্থির পায়চারি করতে থাকে। কিন্তু তানিয়ার কোনও রিপ্লাই পেল না সে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে, তবে কি তানিয়া ভুল বুঝল? অনেকক্ষণ পর রিপ্লাই দিল তানিয়া— অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুম আসছে না। তুমিই আমার প্রথম প্রেম। তোমায় ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া এ জীবন বৃথা…। আরও অনেক কথা বলতে চাইছিল সে। তার আগেই তানিয়া লিখল—আপনাকে দাদার মতো শ্রদ্ধা করি। মন দিয়ে ঘর সংসার করুন…।
ফারুকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এত রাতেও নীচের রাস্তা দিয়ে কোন এক মাতাল হিন্দিগান গাইতে গাইতে চলেছে। মুঝে পিনেকা সখ নেহি, পিতা হু গম ভুলানে কো… তেরি ইয়াদে ভুলানোকা…। ফারুক সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

সেদিনের পর থেকে তানিয়ার সাথে যোগাযোগ কমে এসেছে। চাইলেই কি সব এক নিমেষে ভোলা যায় ? মন কারো বশীভূত হয় না। একদিকে সংসারের প্রতি দায়িত্ব। অন্যদিকে তানিয়ার প্রতি গভীর টান। মাঝে মধ্যে ধর্ম সংকটে পড়ে যায়। স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের প্রতি অবিচার করছে নাতো? এত বছরে সানিয়া তার সব টুকু উজাড় করে দিয়েছে। সানিয়া তার কলেজ প্রেমকে উপেক্ষা করেই ফারুককে জীবনসঙ্গী করেছিল বাবামায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। এদিকে সে সানিয়ার প্রতি অন্যায় করছে নাতো…? অফিস ঘরে বসে এসবই এতক্ষণ ভাবছিল। অফিস ক্লার্ক গোবিন্দদা আজ ছুটিতে। গোবিন্দদার স্ত্রীর শরীর খারাপ ডাক্তার দেখাতে যাবে। বেশ রসিক লোক গোবিন্দদা। যতক্ষণ অফিসে থাকে অফিসঘর গম গম করতে থাকে। আজ সব যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ ফোন আসে। রহমান জানতে চায় নবদিশার পরবর্তী ক্যাম্প কোথায়? বীরভূমের কোথাও হবার কথা। টুকিটাকি দু’চার কথা বলে ফোন ছেড়ে দেয়। ঘড়িতে বেলা দুটো পার হয়েছে। টিফিন খেতে ক্যান্টিনে চলে যায় চটপট। | আজো চোখে ঘুম নেই ফারুকের। মনে শান্তি নেই। একদিন সে তানিয়াকে পাবার জন্য খেলাধূলা, পড়াশুনো, সবেতেই পুরস্কার আনতো। লিখতে বসে যার মায়াবী চোখ হয়ে উঠতো প্রেরণা। শুধু তাকে ভালবেসে, তাকে দেখানোর জন্য দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তো। ভালবাসার কথা কখনো মুখে বলার সাহস হয়নি। তানিয়াও কি কখনো একটুও বোঝেনি? আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এত খ্যাতি তবে তা কিসের জন্য? কার জন্য তবে এত সব? তবে কি এ জীবন অর্থহীন? এমনতরো কত ভাবনা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কি গো শরীর খারাপ? এই অবেলায় শুয়ে আছো? সানিয়া জিজ্ঞাসা করে। না, এমন কিছু নয়। সানিয়া খাটের পাশে বসে। চুলে বিলি কেটে দেয়। ফারুকের মনে তখন কালবৈশাখির ঝড়। সানিয়ার স্পর্শও তখন বিরক্ত লাগে। রাইমা বলে, পাপ্পা আজকে বইমেলায় নিয়ে যাবে বলেছিলে? সব যেন ভুলে যাচ্ছে। রাইমা তাগাদা দেয়। সে দিকে কোন ধ্যান নেই। এক রাশ বিরক্তি যেন গ্রাস করছে তাকে। সব অসহ্য লাগছে আজকে।

পরদিন রাইমাকে স্কুলে নামিয়ে অফিস চলে আসে। একবার তানিয়ার মুখোমুখি হওয়া দরকার। সরাসরি জানতে চাইবে, তাকে বিয়ে করতে চায়। তাকে ছাড়া এক মুহুর্ত অচল। ফোন করে। রিং হয়ে থেমে যায়। তিনবারের বার ফোন ধরে। হ্যালো… বলুন। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কোন রকম ভূমিকা না করেই সরাসরি বলে ফেলে ফারুক। তানিয়া ধীরে ও খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলে, আবারও বলছি আপনি দাদার মতো। স্ত্রী সন্তানের প্রতি নজর দিন। সরি, আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। কিন্তু তানিয়া…। আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দেয়। দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক্ আওয়াজটা যেন আজ ঢং ঢং করে বাজছে ফারুকের বুকের মাঝে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দু’ফোটা অশ্রু কি গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে…? কতক্ষণ এভাবে বসেছিল সে বুঝতেই পারেনি। গোবিন্দদার ডাকে হুঁশ ফিরল। ধীরে পদক্ষেপ বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল সে। যার জন্য জীবনের এত আয়োজন। যে ছিল তার প্রেরণার উৎস। যার স্বপ্নে বিভোর শূন্য জীবনের লড়াই করে আজকে উঠে দাঁড়িয়েছে। দুঃখ, হাসি, আনন্দে যার মুখ ভেসে ওঠে। যার চোখের ঝিলিকে এ মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। পরীর মতো সেই রাজকন্যাই ছিল ফারুকের ভালবাসা। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠিকই লিখেছিলেন, “বাল্যের প্রেম অভিশপ্ত! জীবনের প্রথম প্রেম পরিণতি পায় না। কিন্তু সত্যিই কি প্রথম প্রেম এত সহজে ভোলা যায়? তানিয়াকে এত সহজে ভোলা যায়? তানিয়া একটি স্বপ্নের নাম। সেই স্বপ্ন যা সে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে। সে চাইলে তো সব ছেড়ে ছুটে আসতো পারতো। সে চাইলে আরেকটি তাজমহল গড়ে দিতে পারতো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। নিজেকে একজন হেরে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছে। যে নিজের হেরে যাওয়াকে ঘৃণা করতো। যার জন্য সে এ পর্যন্ত জিতে এসেছে। আজ তার কাছেই হেরে গেল। তার হাতে বোধহয় সেই ভাগ্যরেখাটাই নেই। যা দিয়ে তানিয়াকে জয় করা যায়। ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে আর কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? তানিয়া কোনও দিনও কি জানতে পারবে, তার জন্য সে কত কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগ করছে? প্রেম এত নিষ্ঠুর! তানিয়া এত অবুঝ? ফারুক আজ দিশেহারা এক প্রাণচঞ্চল পথিক! কিনারা কোথায় সে নিজেও জানে না।…

তানিয়ার সেই কথাটা আজো কানে বাজে। সে বলতো, আপনার স্বভাব যাবে না। একবার নয়, বহুবার বলেছে। যাবে কেমন করে? এই স্বভাবের জন্যই তো এত প্রেম! আর এত প্রেম ছিল বলেই যা কিছু সৃষ্টি। জগতের যা কিছু সৃষ্টি সবই তো প্রেমের জন্যই। বিধাতা যদি প্রেম না দিত, তাহলে বোধহয় জগতে সৃষ্টিই হতো না। না, এত কথা তানিয়াকে কখনো বলেনি। সব কথা বলা হয়ে ওঠে না। কিছু কথা নীরব থাকে! কিছু অনুভবে! কিছুদিন থেকে পরিবর্তনটা সানিয়ার চোখেও ধরা পড়েছে। ফারুক এড়িয়ে যায়। তবে এত বড় পরিবর্তনের জন্য সানিয়াও প্রস্তুত ছিল না। ফারুক মনে মনে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। আর নয়। শহরের এই কোলাহল, তানিয়ার ছায়া থেকে বের হতে হবে। না হলে তাকে নিঃশেষ করে দেবে। দূরে, অনেক দূরে চলে যাবে। আবার নতুন করে গুছিয়ে নেবে নিজেকে। এই প্রেমহীন মনে আর সৃষ্টির আনন্দ নেই। যদি সৃষ্টিশীলতাই হারিয়ে যায় বাঁচবে কেমন করে? কার জন্য অপেক্ষার প্রহর গােনা? কবিতার খাতা, ভালবাসার আকাশ জুড়ে তার কাছে এখন শুধুই শূন্যতা।

গাড়িতে সব মালপত্তর ওঠানো হয়ে গেছে। তবু শেষ বার এই ঘরটাকে ভাল করে খুঁজে দেখে কিছু পড়ে রইল কিনা। যদিও ভাড়া বাড়ি। তবু কয়েক বছরে নিজের ঘর হয়ে উঠেছিল। ঘরও আপন হয়। কিন্তু কিছু মানুষ কখনো আপন হয় না। যতই হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দাও না কেন! বিদায় বেলায় বাড়িওয়ালা, ওনার স্ত্রী, মেয়ে সবার চোখে জল। এ দিকে এলে এসো একবার। বাড়িওয়ালার স্ত্রী কথাটা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ফারুক সান্ত্বনা দেয়। বলে, নিশ্চয় আবার দেখা হবে। ভাঙড়ে নিজের বাড়ির থেকে এ বাড়িটাও কম আপন ছিল না। আবার এক নতুন বাড়ির পথে..। আর কথা বাড়ায় না। নিজের টাটা নেক্সা গাড়িতে গিয়ে বসে। সানিয়া, রাইমা, রেহান মাঝের সিটে বসেছে। ফারুক সামনে বসে। ইশারা করতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। কেউ জানে না কী ঝড় বয়ে চলেছে। ফারুকের মনে। আজ তানিয়ার বোনের বিয়ে। কাজি সাহেবের সামনে যখন তানিয়ার বোন কবুল কবুল বলে জীবন সঙ্গীকে আপন করছে, তখন সপরিবারে ফারুক অনেক দূরের পথের সওয়ারি। চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। দু’গাল বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। সেও কাউকে এ যন্ত্রণার ভার দিতে পারছে না। প্রেম কি এত যাতনা ময়…? তানিয়ার ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে অথচ তানিয়া আজও অবিবাহিত। সে তার পবিত্র প্রেমের মর্যাদা আজও বুকে বহন করে চলেছে।
গ্রামের শেষ প্রান্তে এক প্রাচীর ঘেরা নতুন বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায়। লরি আগেই পৌঁছে গেছে। দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। গাড়ি ভেতরে ঢুকে যায়। সানিয়া ও রাইমা খুব অবাক হয়ে যায়। শান্ত নিরিবিলি প্রেমময় এই শান্তিনিকেতন কবে তৈরি করলে পাপা? জীবনের বাকিটা দিন এখানেই নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। সাত বিঘা জমির উপর স্কুল ভবন।

নিজেদের থাকবার বাড়ি ছাড়াও কাঠা দশেকের ছোট্ট একটা পুকুর আছে। কিছু জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। অনেক দিন পর নগর সভ্যতার ছায়া এড়িয়ে পল্লীর সবুজ ঘাসের উপর পা এলিয়ে বসে পড়ে ফারুক খান। পেছনে হলুদ সরষে খেত। মটরশুটির লতা জড়িয়ে ধরেছে। আর গোধুলির আকাশটা রঙে রঙে যেন সেজে উঠেছে। সে দিকে চেয়ে আবার বাঁচার ইচ্ছেটা তীব্র হচ্ছে। হাতটা নিশপিস করছে। কালি কলম মন আবার এক হয়ে উঠবে বোধহয়। হঠাৎই তানিয়ার ফোন আসে। ফারুক ফোনটা ধরে। ওপার থেকে তানিয়া – এই তুমি আজ বোনের বিয়েতে এলে না? ফারুক ধীর স্থির কণ্ঠে জানায়— আমি এখন আর কোনও বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করি না। তুমি জানো না। ওপার থেকে তানিয়ার কান্না ভেজা গলায় ভেসে আসে—আজও আমি তোমায় ভালবাসি। তুমি যতোই দূরে থাকো না কেন, আমি সেই ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার কথা এবং আমার প্রথমপ্রেম ভুলতে পারিনি। খুনসুটি আদর তােমার মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। তুমি তো কথা রাখতে পারোনি। না তুমি অপেক্ষা করেছিলে। আমি আব্বিকে রাজি করতে পারিনি।..
অনেকদিন পর দুজনের অনেক কথা হয়। ফেলে আসা দিনগুলো সব স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। দুজনের মনের মধ্যে আবার নতুন করে ভালবাসার ঝড় ওঠে।—এই তোমার মনে পড়ে গৌতম আর লিপির কথা।

শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। এ বছর শীত বেশo ভালই পড়েছে। শীতের সাত সকালে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল গৌতম। নিজের দু’চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রতিদিনের মত সকালে বাড়ির পেছনে ফাকা জায়গায় ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম করছিল। তখনই চোখ পড়ে কখন যেন চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে লিপি। কিন্তু এই ঠিকানাতো লিপির জানার কথা নয়। তবে কি ফারুক ওকে দিয়েছে? কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে ওর…! আহামরি সুন্দরি ছিল না। কিন্তু পটলচেরা চোখের মুখশ্রীকে একটা আলাদা সৌন্দর্য ছিল, যা সহজেই নজর কাড়তো। একদিন পাগল ছিল গৌতম এ মেয়ের জন্য। সেই স্কুল জীবনে প্রথম দর্শনেই ভাল লেগেছিল গৌতমের। সেই ভাললাগাটা একটা সময় লিপিও বুঝেছিল। বিষ্ণুপুর কালিবাড়ি মেলায় লিপিকে হারিয়ে ফেলেছিল। মা কালির সামনে গিয়ে প্রার্থনা করেছিল, লিপিকে খুঁজে দাও মা–। সেই ছেলেমানুষি কথা মনে পড়লে হাসি পায়। ফুটপাতের গৌতমের দাদার পান-বিড়ির দোকান ছিল। স্কুল ছুটির দিনগুলোয় সেই দোকানে বসতো। দোকান থেকেই লিপিদের বাড়ি দেখা যেত। সব গতিবিধি ও নজরে পড়তো। বৃহস্পতিবার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। সেদিন সকালে পান সুপারির জন্য প্রতি সপ্তাহে লিপি আসতো দোকানে। সেই বৃহস্পতিবার যেন আসতেই চাইতো না। টুকটাক দু’চার কথার বেশী হোত না। হাল্কা হাতের ছোঁয়ায় ব্যাকুল হোত প্রাণ। ভালবাসার কথা কখনও মুখ ফুটে বলার দরকার হয়নি। চোখের ভাষায় বুঝেছিল দু’জনেই। আর তখন মোবাইল ছিল না।

ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয় গৌতম। কিন্তু সাংসারিক জটিলতায় উচ্চ মাধ্যমিক আর দেওয়া হল না। তারপর থেকে প্রায় নিয়মিতই দোকানে বসতো।
আজ তোমাদের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম বোনের সাথে কাটিগঙ্গার জলে গোধূলির রং ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে ছিল গৌতম। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। —কি গো শুনতে পাওনি? হ্যাঁ বল! পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে লিপি। কানে ওর গরম নিঃশ্বাস এসে লাগছে। গৌতমের কানের লতিতে হাল্কা কামড় দেয় লিপি। আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না গৌতম। সন্ধের এই আলো আঁধারিতে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে লিপির অধর সুধা পান করতে থাকে। লিপি বিহ্বল হয়ে পড়ে। সম্বিৎ ফিরতেই এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুট লাগায়। এলোচুলে বার দুয়েক পেছন ফিরে তাকায়। তারপর দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। গৌতম সেই চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে। সে দিন ছিল দোলপূর্ণিমা। পূর্ণচাঁদের আলোয় মোহময় হয়ে উঠেছিল চারপাশ। দোলের এক ফোঁটাও রং ছিল না গায়ে। কিন্তু দুটি মন রঙে রঙে ভরেছে সে দিন।

সেদিনের পর যেন সব বদলে গেল। দুজনের দেখাশোনা বন্ধ হয়ে যায়। লিপির বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হয়। সরকারি চাকুরে পাত্র পেয়ে অচিরেই লিপির বিয়ে হয়ে গেল। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছিল এখন। একটি বার জানাল না পর্যন্ত কেন সে এমন কাঠার সাজা দিল। আর বেকার ছেলের সাথে কোন বাপ তার মেয়ের প্রেম মেনে নেবে..? কিন্তু গৌতম হৃদয় দিয়ে লিপিকে ভালবেসেছে। হৃদয়ের গোপন কুটুরিতে সেই ভালবাসা তুলে রেখেছে। শুধু এটা ভেবে অবাক হয়েছে, একবার মুখের কথাটা বলতে পারতো লিপি। কিছু না বলেই এভাবে তাকে ঠকিয়ে অন্য পাত্রের হাত ধরে চলে গেল? বিয়ের রাতে যতক্ষণ সানাইয়ের সুর বেজেছিল, কাটিগঙ্গার পাড়ে সেই জায়গাটায় বসে অঝােরে কেঁদেছিল গৌতম। সাক্ষী ছিল নিঝুম রাতের আকাশ ভরা তারারা।
তারপর দোকান বেচে দেয়। ওখানে আর থাকেনি। আজ প্রায় কুড়ি বছর পর লিপির দেখা। সেই চোখ একই আছে। লাবণ্যটাই আজ ফিকে হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে দুজনেই। কত কথা মনে পড়ছে। একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করে…! কিন্তু চুপ হয়ে যায় গৌতম। পাশেই শান বাঁধানো বকুল গাছের গোড়ায় বসতে বলি লিপিকে। বলো এখানকার ঠিকানা কোথা পেলে? কেমন আছো? ফারুক ভাইয়ের কাছে তোমার খোঁজ পেয়েছি। লিপি বলল। ওর পত্রিকায় তোমার লেখা পড়েই বুঝেছি তুমি ছাড়া এ লেখা অন্যকারো হতেই পারে না। গৌতম বহু দিন ধরেই সংবাদপত্রে লেখালেখি করে আসছে। জীবনে আজো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এখনো বাঁচার লড়াই চলছে। —তোমার কথা বলো? লিপির কাছে জানতে চায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হয়। হঠাৎ করেই গৌতমের দুহাত চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। গৌতম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। লিপির কান্না থামতেই চায় না। কপালের লেখা কেউ খণ্ডন করতে পারে না। এই দেখো না আমি একলা বেশ আছি— গৌতম বলে। ফারুককেও এক ভণ্ড জ্যোতিষী আজম মহালদার তার হাত দেখে বলেছিল, তানিয়ার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে। এ সব বলে মোটা টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এ সব ভণ্ড জ্যোতিষীরা হচ্ছে বদের আঁটি। লোক ঠকানোই এদের কাজ!

ভাগ্যের কাছে আমরা সবাই অসহায়! এইসব ভণ্ড জ্যোতিষীদের থেকে মানুষ যতই দূরে থাকবে ততোই মঙ্গল। সানিয়া ও তানিয়া অনেক বুঝিয়ে সুপথে ফিরিয়েছে ফারুককে। একটু ধাতস্থ হয়ে ওঠে লিপি। তারপর সে বলতে আরম্ভ করে। সেদিনের সন্ধার ঘটনাটা পেছন থেকে আরো কেউ দেখেছিল। সে রাতেই বাড়িতে বাবার কানে পৌঁছে যায় সে খবর। এমনিতেই খুব রাগী মানুষ। খেতে বসে সে কথা তুললো বাবা। মা, ভাই কেউ বাবার ভয়ে চুপ। আমি যে তোমাকে ভালবাসি সে কথা সাহস করে বলেছিলাম। বাবা ভাবতেই পারেনি আমি এমন করতে পারি! কি ভেবে বাবা হঠাৎই আমার হাতটা ধরে মাথায় দিব্যি দিয়ে বলল, আর যদি কখনো গৌতমের সাথে মেলামেশা করিস তাহলে আমার মরামুখ দেখবি! ভয়ে, আতঙ্কে শরীর যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। সব চিন্তা শক্তি লোপ পেল। বাবার কথা মেনে নিলাম। এক মাসের মধ্যে দিবাকরের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তিন বছরের মধ্যই এক মেয়ে ও এক ছেলের মা হয়ে গেলাম। সরকারি চাকরি হলে কি হবে? বিড়ি, সিগারেট, মদের নেশার সঙ্গে মেয়ে মানুষের নেশাও পেয়ে বসল দিবাকরের জীবনে। স্ত্রী সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করতো না। বিয়ের চার বছরের মাথায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে একটি খারাপ মেয়েছেলেকে নিয়ে থাকতো। গায়ে পর্যন্ত হাত তুলতো।

এক সময় সব অসহ্য হয়ে ওঠে। সন্তানদেরকে নিয়ে এক কাপড়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। বাবাকে খুব অসহায় লাগতো। তিনটে পেট নিয়ে আর কত দিন বসে খাওয়া যায়। কিন্তু কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেলাইয়ের কাজ জানা ছিল। বুটিকের প্রতি আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁত শাড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু করি, চেনাজানা মহলে। সেভাবে জমছিল না। একজনের পরামর্শে থান শাড়ি কিনে এনে তাতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। নিজের হাতে নানান নকশা করে তা শাড়িতে ফুটিয়ে তুলি। ধীরে ধীরে এ ধরণের শাড়ি বিক্রি বাড়তে থাকলো। বছর পাঁচেক পরে বাবার বাড়ি ছেড়ে এখানে ভাড়া বাড়িতে উঠে আসি। পসার একটু জমলে ‘লিপি বুটিক’ নামে শাড়ি তৈরি শুরু হয়। একা পেরে উঠি না। আরো কয়েকজন মেয়েও কাজ করে। মেয়ে কলেজে পড়ছে। ছেলে এবার মাধ্যমিক দেবে। কী খাবে বলো? গৌতম জিজ্ঞাসা করে।

আজ দোল পূর্ণিমা। সেদিনও দোলপূর্ণিমা ছিল। মনে রং ছিল। আজ তা বিবর্ণ ফ্যাকাসে।—তুমি বিয়ে করলে না কেন? লিপি জানতে চায়। আর হয়ে উঠল না। এই বেশ ভাল আছি। গল্পে গল্পে অনেক বেলা হল। লিপি উঠে পড়ে। মাঝে মাঝে আসার কথা দিয়ে যায়। ধীর পায়ে লিপি চলে যায়। গৌতম আজও সেই চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে। সে দিনের সেই চঞ্চলতা আর অনুভব করল না। শুধু একরাশ শূন্যতা নেমে এল হৃদয় জুড়ে। আর চোখ দুটো ভারি হয়ে উঠল…। এমন সময় মোবাইলে ফারুকের ফোন এল। গৌতম গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তৈরি হয় ফারুকের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আজ বহু দিন পর লিপি আবার ওর মনের আকাশ জুড়ে রং ছড়িয়ে গেল…। বেশ চলছিল তানিয়া ও ফারুকের ফিরে পাওয়া প্রেম। সামনের মাসেই ১২ জানুয়ারি ফারুকের জন্মদিন। তানিয়া মনে মনে ভেবে রেখেছে সে এবার তার জন্মদিন বড়ো ঘটা করে পালন করবে। দুজনে একান্তে কলকাতার কোনও রেস্তোরাঁয় মিলিত হবে। একসঙ্গে দুজন অনেকক্ষণ মুখোমুখি বসবে। ভালবাসা আর মনের না বলা কথাগুলো একে অপরে শেয়ার করবে।

কিন্তু ফারুক তার নতুন জীবনে একটু একটু করে মানিয়ে নিতে শিখছে। তানিয়া নামক স্বপ্নের রাজকন্যার মোহ থেকে বের হয়ে সানিয়ার জীবন সঙ্গী হয়ে বাঁচার শপথ নেয় মনে মনে। গোধূলির অস্তরাগ বহু দিন পর কবিতার খাতার কথা মনে করালো।তানিয়া স্বপ্ন নায়িকা! সানিয়া জীবন নাওয়ের দিশারি! বহু দিন পর দখিনা বাতাস বইছে। বিস্তীর্ণ আকাশ দেখছে ফারুক। ডুবন্ত সূর্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

লেখক : অশোক পাল। বিশিষ্ট পত্রলেখক। তিনি কবি ও প্রকৃতি প্রেমিক। মুর্শিদাবাদ জেলার ফুলবাগান এলাকার বাসিন্দা। ‘প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির কাছে’ তাঁর ইউটিউব চ্যানেলটি ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে।

Related Articles

Back to top button