গল্প ও কবিতা

অঞ্জুমালা’

‘রুপালী রায়

রাত গভীর ।তখন প্রায় একটা হবে আমি ঠিক খেয়াল করিনি ।একটা ইমপরট্যান্স কাজ ছিল ঘুমইনি তখনও ।কোলাহল শূন্য জনপদ, নিঝুম রাত একটা দুটো ঝিনুকের ডাক ছাড়া কিছুই নেই ।অস্পষ্ট কন্ঠে দূর হইতে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল ।একটা ছোট্ট শিশু কন্যার কান্নার মতো বোধ হচ্ছিল ।কান পাতিয়া শুনিলাম-এ কান্নার আওয়াজ আমাদের বাড়ি দিকে আসতেছে ।প্রথমে কিছু একটা ভয় হলেও সাহস করে জানলার পর্দাটা সরিয়ে অস্পষ্ট ভাবে এক মহিলা কোলে এক শিশু কন্যা সমেত তিনটি ছেলে সন্তান দেখলাম ।মোবাইলের আলোটা জ্বালা মাত্রই সবকিছু স্পষ্ট হইল দেখলাম আমাদের বাড়ির কাজের মামা নিতেন বাবুর মেয়ে ও সাথে উনার নাতি-নাতনি।
কান্না শুনিয়া সকলের ঘুম ভাঙিয়া গেল ।তারপর যা শুনিলাম —-সেকথা না বললেও আমরা সকলেই প্রায় আন্দাজ করতে পারছিলাম ।কারণ এ ঘটনা আজ নতুন নয় পাড়ার প্রায় সকলেরই জানা ।সংক্ষেপে বলছি-
‘মেয়েটি বাবার বাড়িতে থাকে আজ প্রায় ছয়-সাত বছর হলো ।তিনটি পুত্র সন্তান,একটি শিশু কন্যা নয় মাসের হবে ।স্বামী যে কি পরিমান নেশাখোর তা উদাহরন না দিলে বুঝা সকলের পক্ষে সম্ভব নয় ।

        নেশা মানুষের জীবনের কি পরিমাণ চরম পর্যায়ে আনিতে পারে তা একমাত্র তাকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি ।একটা মনুষ্যত্বহীন মানুষ যে কি পরিমান ভয়ংকর হতে পারে তাকে না দেখলে আমি হয়তো কোনোদিনই তা আন্দাজ করতে পারতাম না ।যাই হোক-
    বাবার কাছে যা শুনলাম বিয়ের  দিন, যতদিন শ্বশুর মশাই জীবিত ছিলেন ততদিন স্বামীর ঘর চিনেছে, তারপর আজ পর্যন্ত  স্বামীর ঘরের রোজগারের অন্ন মুখে তোলা হয়নি ।

বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, কিন্তু একমাত্র মেয়ে, মায়া যে বড়ই জটিল । দায় এড়াতে গিয়ে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলেন, সে দায় যে দ্বিগুণহয়ে ঘাড়ে এসে চাপবে তিনি কি আনতেন?এই করোনা কালীন সময়ে বৃদ্ধের যা রোজগার হয় তাতে বুড়ো-বুড়ির নিজেদেরই জল গরম হয় না।তার উপরে এতজন সদস্য ।
কখন কোথায় যায় কোনো ঠিক ঠিকানা নেই ।মাস দের এক হলো কোনো খবর নাই ।কোথায় ছিল কেউ বলতে পারে না ।হঠাৎ বাড়ি ফিরলো চোদ্দ দিনের হোম কোয়ারেনটাইন ।কেউ সাহায্য করবে না এই সুযোগে চরম নির্যাতন, এইবার শ্বশুর-শাশুড়িও বাদ পড়লেন না।নিজের বাড়ি জামাতাকে দিয়ে ঠিকানা হলো রাস্তা ।
ঘরের সমস্ত কাগজ পত্র পুড়িয়ে ছারখার ।শাড়ির আঁচল সরলেই দেখা যায় দলা পাকানো মাংস পিণ্ডগুলো আর প্রিন্টেট শাড়ির নকশা আঁকা ।দুঃখের পরিধি কতদূর গড়ালে জীবন এমন পর্যায়ে পৌঁছায়।
এক তো করোনা কালীন সময়ে কেউ চাইলেও প্রাণের মায়ায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে রাজি হয়না । দ্বিতীয়ত কেউ যদি দয়াবশত আশ্রয় দিতে চান এমতাবস্থায় পরিবারের আপত্তি, প্রতিবেশীদের আপত্তি ।সব কিছুর অভিমুখে থুরি মেরে বাবা রাজি হলেন আশ্রয় দিতে ।সামনে একখানা নতুন ঘর ছিল খালি ।বাবা বললেন-আপাতত সেখানেই থাকা হোক ।কিন্তু তাতেও যে হাজার রকম সমস্যা ।
বাচ্চাগুলোর মুখ পানে তাকাইলে বড়ই মায়া জন্মে কিন্তু কে কার ঘরে কতদিন ঠাই দিতে চায় ,একে তো এই মহা দুর্যোগ করোনার সময় ।তবুও বাবা বলেছিলেন আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য ।কিন্তু সকলেরই যে বিবেক বলে কিছু থাকে, তাই হয়তো কিছু একটা জুড় করার পরও রাখতে পারা যায়নি ।
গ্রামের লোকজন বললেন পুলিশে যেতে, কিন্তু সেখানে যে মেলা টাকার প্রয়োজন। সকলেই জানতেন পুলিশ কমপ্লেইন করা এদের সাধ্যের কাজ না ।বলে দিয়েই কাজ শেষ ।সকলেরই সংসার আছে কে চাইবে অযথা অন্যের সংসারের দায় সামলাতে ।চোখের সম্মুখে এমন করুণ দৃশ্য দেখলে কেউই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পারে না সরাসরি ।তাই হয়তো কিছু একটা বলে চোখ ফিরাইয়া নেয় ।সে পরামর্শটা তাদের জন্য যুক্তিযুক্ত কি না তা দেখার সময় কারো নেই ।
সন্ধ্যার ঘন অন্ধকার চোখে রাস্তার মোড়ে তখনও সূর্য কিরণের ঝিকিমিকি আলো খিলখিল করে হাসছিল ,গোধূলির আলোয় আলোয় মিশে যাওয়া নিথর দেহ এক শূন্য ভূমিতে এক টুকরো কাষ্ঠ খণ্ডের মতো অঞ্জুমালা , পাশে তার ফুটে
উঠা সন্ধ্যা মালতির পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ।
ঘনিয়ে আসা সমুদ্র সন্ধ্যায় ঘনঘন নিস্তব্ধ তরঙ্গ রাশির কলকল ধ্বনিতে অশ্রুধারা হৃদয়ের চরমতম পর্যায়ে । ।

Related Articles

Back to top button